Saturday, 29 June 2019

Tama Barman

গল্প
               ত  মা       ব  র্ম  ণ


                       ভগ্নবৃত্ত




মেয়েটারে একটু খেয়াল করো তো নাকি? সারাদিন কি অত ভাবে? এই বয়সী, অল্পতেই বদহাওয়া লাগতে কতক্ষণ?
বিনায়ক মাধুরীকে একটু শাসানোর গলায় জিজ্ঞেস করলেন। আড়চোখে দেখলেন তার মুখেও যথেষ্ট বিরক্তির ছাপ। মেয়েকে নিয়ে সেও নাজেহাল। কিন্তু তা হলে তো চলবে না। চাকরিবাকরি সংসারের হাজার দাবি নিয়ে তিনি ঘরে বাইরে ব্যস্ত থাকেন, মাধুরীকেই সব খেয়াল রাখতে হবে। দিনরাত মন্দিরে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা, রাধামাধবের সেবা করতে করতে যে মেয়েটা সব খেয়ালের বাইরে চলে যাচ্ছে তার হুঁশ পর্যন্ত নেই! বিনায়ক বেরোবার মুখে উঁকি দিয়ে দেখলেন রাই আনমনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। সকালের রোদ মায়ার মতো জড়িয়ে ধরেছে তার কচি মুখটা।
কি রে আজ কলেজ যাবি না? আর তো মাত্র কটা দিন বাকি। বিনায়ক মেয়ের মাথায় সস্নেহে হাত রাখেন। রাই মুখ ঘুরিয়ে হাসল। যেন কোথায় এতক্ষণ ডুবে ছিল, ভেসে উঠে বলল, না বাবা ফাইনাল তো এসেই গেছে, তাই কলেজ থেকে স্টাডিলিভ দিয়েছে কটাদিনের। অনেক রাত পর্যন্ত কাল জেগেছি। ভাবছি একটু পর সাথীর কাছে একটা নোট আনতে যাব।
বিনায়ক আর কথা বাড়ালেন না। বরং ভাবতে লাগলেন আজকেই অফিস ফেরত একবার বন্ধু সুধীরের কাছে যাবেন। সুধীরের ছেলে আই টি সেক্টরে কাজ করে, ব্যাংগালোর থাকে। দাবি দাওয়া কিছুই নেই। সুধীরেরই ব্যক্তিগত আবদার বহুদিনের বরং তার ছেলের জন্য রাইকে চাই। আর হবেই-বা না কেন? আজকাল রাইয়ের মতো মেয়ে কটা আছে? হতে পারে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার নয় কিন্তু রাই আর সবার চেয়ে একদম অন্যরকম। এতো ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে জানে, ছবি এঁকে ঘর সাজিয়ে রাখে। শ্রাবণমাসে যখন মাধুরী বাড়িতে হরিনাম সংকীর্তন দেয়, তিনদিন এই তল্লাটের মানুষের ভিড় সামলানো, প্যান্ড্যাল লাগিয়ে খিচুড়ি ভোগ হয়, সবাইকে তৃপ্তি করে খাওয়ানো এসব কি কম ঝক্কির কাজ? সেই ছোট বয়স থেকেই এসব দেখে দেখে রাইও মায়ের সাথে সাথে হাত চালিয়ে যায়। তাছাড়া সামন্ত গোঁসাইও আসেন বাড়িতে থাকতে তখন। প্রায় চার পাঁচদিন তাঁর সেবাযত্নের দিকেও খেয়াল রাখতে হয়। মাধুরী বাকি সামলায়, রাই তাঁর সব দেখাশুনো করে। এই নিয়ে বিনায়ক কম অশান্তি করেননি শুরুতে। ওই কটাদিন মেয়ের স্কুল লাটে উঠে যেত তা তিনি কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারতেন না। অথচ, এসবে মাধুরীর বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। এই পাড়ায় তারাই একমাত্র বৈষ্ণব পরিবার। যার ফলে বাপ ঠাকুর্দার আমল থেকেই ওরা আলাদা মান্যগন্যি পেয়ে এসেছে সবার কাছে। আগে বছরে দুবার হরিনাম সংকীর্তন হতো, দল বেঁধে কীর্তনিয়ারা আসতেন, থাকতেন। যৌবন বয়সে বিনায়করা চার ভাই মিলে বাবার এসব কাজে হাত লাগিয়ে টেনে গেছে। এখন সব অতীত। ধীরে ধীরে রাজার ধড়াচুড়ো খসে পড়ার মতো বাকি ভাইরাও যে যেদিকে পেরেছে জীবিকা নির্বাহে সরে পড়েছে। বড় বলে পারিবারিক এই রীতিটি শুধু বিনায়কই সামান্য কেরানীর চাকুরিতেও যতটুকু পারেন ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এখনও এদিক ওদিক থেকে গোঁসাইরা আসেন এই বাড়িতে। কিন্তু দিনকাল পাল্টেছে, বোঝেন এভাবে অচেনা অজানা গোঁসাইদের ডেকে এনে বাড়িতে রাখাটা খুব একটা নিরাপদও নয়। শুদ্ধ গোঁসাই কতজন আছেন তা সন্দেহ এখন! এক সামন্ত গোঁসাই সেই যৌবন বয়স থেকেই এখানে নিয়মিত আসতেন। মূল গায়েন হয়ে গাইতেন। দোহাররা যখন সেই সুর ধরে টান দিত কীর্তনের আসরে, আহা, সারা গ্রাম তাদের সাথে নেচে উঠত! কিন্তু হঠাত কেমন করে যেন নিখোঁজ হয়ে রইলেন বহুবছর!
মাধুরীর ইচ্ছে রাইয়ের ফাইনাল হয়ে গেলে আবার একটা হরিনাম সংকীর্তন দেবার। বহুবছর পর স্বেচ্ছানির্বাসন ভেঙে সামন্ত গোঁসাই আবার এখানে আসতে চাইছেন। এতদিন কোথায় ছিলেন কেউ জানে না। সেই শুনেই রাই কেন যে থম মেরে গেছে তাইই বিনায়ক বুঝতে পারছেন না। নাকি সুধীর কাকুর ছেলের সাথে বিয়ে হলে অন্য আরেক শহুরে জগতে গিয়ে তাকে মানিয়ে নিতে হবে তা ভেবে শঙ্কিত কে জানে! মেয়েদের মনের কথা বাপ কবে আর চেয়ে বুঝতে পারে? তেমন হলে দরকার নেই, কাছেপিঠেই ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেবেন রাইকে। ফাল্গুন মাসের হাল্কা আমেজ, চাদরটা গায়ে জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। আজকাল ঘুম আসতে চায় না। কটা বছর আর আছে চাকরির। রাই চলে গেলে কি নিয়ে থাকবেন তিনি? মাধুরী তো চিরকাল কপালে রসকলি এঁকেই দিন কাটিয়ে দিল সংসারে। এই তল্লাটের সবাই তাকে বৈষ্ণবী মা বলে ডাকে। এরপর মন্দিরের দরজা বন্ধ করেই বসে থাকবে হয়ত সারাক্ষণ।

রাইয়ের ঘরের কাছে এসে দাঁড়ালেন। হাঁটুতে মুখ রেখে উবু হয়ে বসে রাই। এতো রাতে এমনভাবে বসে কি করছে ? দরজাও ভেতর থেকে লাগায়নি।

রাই, মা আমার কি হয়েছে তোর? এমন করে দরজা খুলে বসে আছিস কেন, বল? কি কষ্ট তোর একটিবার খুলে বল দেখি। আমি তোর বাবা, সব ঠিক করে দিতে পারি চাইলে। বিনায়ক কাতরে উঠলেন। রক্তজবার মতো চোখ ফুলে ফুলে উঠছে রাইয়ের, চাপা যন্ত্রণায়। বিকারগ্রস্ত রোগীর মতো ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিনায়কের বুকে।

পারবে? পারবে তুমি? তাহলে ধর্মের নামে এই অনাচার এতোদিন তুমি মুখ বুজে কি করে সহ্য করলে? এতদিন সামন্ত গোঁসাই নিখোঁজ থেকে আজ কোথা থেকে এখানে আবার আসতে চলেছেন তার খোঁজ রেখেছো তুমি? রাখলে জানতে পারতে আমি কে? উঁনি বিশ্বাস করেন, সব মেয়েই রাধার অংশ তা সে যে বয়সেরই হোক না কেন। পৃথিবীতে যতো অনাচার,হিংসা, ধ্বংস সব ধুয়ে যাবে যদি গোবিন্দ স্বয়ং এসে তার আত্মায় বসবাস করেন। সেই মেয়ে বিয়ের পর যে সন্তানের জন্ম দেবে তাইই হবে গোবিন্দের অংশ। পৃথিবী পুণ্যে ভরে যাবে। যেমন আমিও সেই পুণ্যের এক ফল। এবার আমাকেও নিয়মমাফিক সেই রাধা হতে হবে মায়েরই সেই বিশ্বাসে। কারন আজ বাদে কাল আমারও বিয়ে হতে চলেছে। পারবে এই ভয়ংকর বিশ্বাসকে ভেঙে দিতে? সবার সামনে?

পাথর মূর্তির মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন বিনায়ক। পুরোনো আমলে তৈরি করা উঠোনের পূবমুখে রাধামাধবের মন্দিরটি। প্রতিবছর চুনকাম আর যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণের কাজে কখনও টাকার জন্য আটকায়নি। সকলেই কিছু না কিছু প্রণামী রেখে যায়। মনে করে, আজপর্যন্ত এখানে কোনো পাপ হয়নি বলেই মন্দিরটি এমন জাগ্রত রয়েছে ! মাঝেমধ্যে অনেকেই চেয়েচিন্তে মাধুরীর কাছ থেকেও রোজকার ভোগের মাধুকরীমাখা খেয়ে যায়।


বিনায়ক কেরোসিন তেলের ড্রামটা উপুর করে দিয়ে গভীর অন্ধকারের ভিতর মন্দিরের প্রদীপটা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।


_____________________________________________________________________

No comments:

Post a Comment