মুক্তগদ্য
অ ভী ক কু মা র দে
তরলকথা
জ লের উপরতলে রোদের খুব কড়াকড়ি কদিন ধরে। সকাল একটু বড় হতে থাকলেই জলের ভেতর হইচই শুরু হয়ে যায়। তলদেশ থেকে উপর তলে আসতে চায় না তরল। একটা দুর্বল অংশ উঠে আসতে চাইলেও অংশবিশেষের চাপাচাপি লেগেই থাকে। জলের তরল জানে এটা একটা মিশ্র বসতি। জোড় চাপাচাপিতে অস্তিত্ব বিপন্ন হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু কিছু করারও নেই। প্রতিদিন সূর্য যেমন উঠবে, রোদের জ্বালাতনও থাকবে। কোন একটা অংশকে তো উপরতলে যেতেই হবে। এই ত্যাগ সার্বিক স্বার্থে। জলের গভীরতা এই ত্যাগকে আত্মবলিদান বলে। উপরতল জ্বলতে জ্বলতে তরল শরীর ক্ষয়ে বাষ্পীয় হয়। তখনও জ্বলন কমে না, আরও ক্ষয়ে হালকা হতে থাকে, উপরে উঠে আসার শাস্তিস্বরূপ আরও উপরে ওঠে। সাহায্য করার মতো বা সান্ত্বনা দেবার মতো কাছাকাছি কেউ থাকে না, যারা থাকে আকাশের ধুলোবালির ওজন কাঁধে বেঁধে লাইনেই থাকে। পেছনে বাতাসের চেঁচামেচি। পরপর গুনে গুনে চাপতে থাকে একের পিছে আরেক। এভাবেই ভাসতে থাকা।
কয়েকদিনের ভেসে থাকা বাষ্প আকাশের ধুলোবালি টেনে শরীরের রঙ বদলে কালো হতে থাকে। আকাশ এমন কালো কালো দলগুলোকে মেঘ বলেই পরিচিত করিয়েছে সবার কাছে। আকাশও তার ময়লা নিজের কাছে রাখতে চায় না। এতদিন ময়লা পরিষ্কারের জন্য কারো প্রয়োজন ছিল। বাতাসের সাথেও আলোচনা হয়েছে অনেকবার। বাতাসের সাফ কথা, ওখান থেকে বের করে আনা তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব, বরং বের করে দিলে জোর করে নিয়ে আসতে পারবে এবং কাজও করিয়ে নিতে পারবে। অনেক ভাবনাচিন্তার পর পুরোপুরিভাবে সূর্যকেই এই কাজে লাগিয়েছে।
আকাশ জানে, কাজ যখন শেষ হয়ে যায় তখন শুধু শুধু ভিড় জমিয়ে লাভ নেই। বাতাসকে দিয়ে মেরে মেরে দুর্বল করে ফেলতে হবে, সুযোগ পেলে মেরেই ফেলতে হবে। পৃথিবীর সব জায়গা আকাশ ভালোভাবেই চেনে। সবগুলো লাশ পাহাড়ের চূড়ায় লুকিয়ে রাখলেই হবে অথবা যে কোন জায়গায় ফেলে দিলেও কোন অসুবিধা নেই।
বাতাস আকাশের ইশারা বুঝতে পারে। আকাশ যখন বলছে তাকে করতে হবে। না করে টিকে থাকা অসম্ভব। সূর্য এমন উগ্র হয়েও অবাধ্য হতে পারে না, আর বাতাস তো সামান্য, তা- ও আবার জানা মতে পৃথিবীতে। সুতরাং কাজ যখন করতেই হবে নিজের হাতে দাগ লাগাবে না। মেঘে মেঘে সংঘর্ষ বাধিয়ে দিলেই চলবে। তাই করলো। আচমকা চারদিক থেকে ধাক্কা দিয়েই চুপচাপ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারপিট হাতাহাতি। চিৎকার, কান্নাকাটি। মরছে মারছে।
একসাথে অনেকগুলো লাশ। জড়ো করে যখন সরিয়ে নিচ্ছিল, তখন একেকটি লাশের অনেক ওজন। স্বাভাবিকভাবেই লাশের ওজন বেশি হয়, ফলে বাষ্পীয় শরীর আবার তরল হতে থাকে এবং শ্রদ্ধাও বাড়ে।
এই তরল এভাবেই নিজেকে জলের উপরতলায় উৎসর্গ করে, বিভাজিত হয়, সাফাই করে আর বর্জিত হয়। এভাবেই ঝরতে থাকে, পড়তে থাকে এবং পুনরাবৃত্তি।
ঋতুর বাড়ি
মূলত ঋতুকে কেউ কোনোদিন চোখে দেখিনি। শুনেছে শুধু এই বাড়িটা ঋতুর। আসলে এই এলাকায় যারা এসেছে কেউ এখানকার স্থানীয় নয়, স্থায়ীও না। এখানে যারা বসবাস করতে এসেছে সবাই উদ্বাস্তু। সময় সময় কাগজে নাম বদলানো হয়েছে, এটুকুই যা। এরা কখনো জংলি, কখনো রিফিউজি, কখনো বা রোহিঙ্গা। যারা এই এলাকায় একটু পুরোনো, ঐসব লোকেরা এই প্রজাতিকে বেড়াইজ্যা বলেই চিহ্নিত করতেন। নিজের বেলায় তকমা লুকানো রোগ। যাই হোক, ঋতুকে না চিনলেও ওর ছেলেমেয়েদের সবাই ভালোভাবে জানে, নিজেদের মতো করে উপলব্ধিও করে।
ঋতুর ছয় ছেলেমেয়ে। প্রথম ছেলে। বড় ছেলে গ্রীষ্ম। ওর এখন অনেক বয়স। যতই বুড়ো হচ্ছে কেমন উগ্র হয়ে পড়ছে ! দিন নেই, রাত নেই সবসময় মাথা চড়া। চারপাশের সম্পর্কগুলো অস্বস্তিতে থেকে থেকে জ্বলে যাবার উপক্রম। যতক্ষণ বাড়িতে থাকে কেউ শান্তিতে ঘুমাতেও পাড়ে না। সবাই তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। যান্ত্রিক হয়ে উঠছে যে যার মতো। এতে গ্রীষ্মের উগ্রতা কমবে তো দূরের কথা, বরং বেড়েই চলছে।
গ্রীষ্মের ছোট বোন বর্ষা। মেয়েটা এমনিতে খারাপ না। ঋতুর বড় মেয়ে। গ্রীষ্মের প্রায় পিঠোপিঠি বয়স। একটু ছোট। সে ছোটবেলা থেকে দিতেই শিখেছে। সংসারের জন্য কী করেনি সে, গ্রীষ্মের সব অন্যায় বা কারোর প্রতি কঠোর কিছু হয়ে গেলে তাকে সান্ত্বনা দিয়েছে। সংসারের সব দায়দায়িত্ব পালন করতে করতে কখন যে অনেক বয়স হয়ে গেছে খেয়ালই করেনি। এখন মাঝেমধ্যে ওলটপালট হয়ে সাংসারিক অঘটন ঘটে যায় দু' একটা। যদিও সবাই তার এসব কিছু মনে করে না, বরং আগেই সবাই তৈরি থাকে। বর্ষার হাতে কিছু এদিক ওদিক হলে আজকাল মেরামতির অভাব নেই। ভেতরে যেটুকু বাতাস নেই তারচে' বেলুন ফোলায় বেশি। ফেটে গেলে সংসারের যাবে, তাতে কিছু যায় আসে না।
শরৎ ততটা সাংসারিক নয়। সবসময় আনন্দ আর ফুর্তিতে দিন কাটলেই হলো। উৎসবের মেজাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসে। ভাইবোনদের মধ্যে তৃতীয় স্থানে অবস্থান বলে কাজের তেমন দায়িত্ব নেই। সেজেগুজে ফিটফাট চলাফেরাকেই জীবন মেনে নিয়েছে।
হেমন্তটাও শরৎ থেকে বিশেষ আলাদা নয়, তবে তার মতো লাগামহীন চলাফেরা ভালোবাসে না। সংসারের সুখদুঃখে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চায়। চাষবাসের খোঁজখবর নেয়। ঘরে ফসল এলে খুশিতে নাচতে থাকে। উৎসব উৎসব মেজাজ তারও আছে, তবে ফসলের উৎসব। সারা বাড়ি জুড়ে মিষ্টি সুভাষ ছড়িয়ে দিতে জানে।
তার থেকে ছোট শীত। সবার ছোটজনের বড়। সবসময় নিজের ভেতর মনমরা হয়ে থাকে। আবেগপ্রবণতার কারণে কুয়াশাচ্ছন্ন জীবন। খোলা মাঠ, জলাশয়, সব্জিক্ষেত এসবের সাথে সময় কাটায়। তার এমন আচরণে সংসারের সবাই কুঁকড়ে থাকে সারাক্ষণ। একটা সময় এমনও অবস্থা হয়, সুখের সব স্মৃতিগুলো মনেও রাখতে রাজি থাকে না। ভেতর ভেতর ঝরতে থাকে আশা আকাঙ্খা। সে জানে, ভাইবোনদের মধ্যে তার লেখাপড়া অনেক বেশি। তার জন্য বন্ধু জলও অনেক সাহায্য করেছে, অনেক ক্ষতিও হয়েছে জলের। বাতাসও কম যায় না সেদিক থেকে, তবুও সংসারের জন্য তেমন কিছুই করতে পারেনি। সে জানে, দাদা গ্রীষ্মও তার থেকে কোন অংশে কম নয়। সংসারের বড় হওয়ার কারণে সব দায়দায়িত্ব তার উপর ছিল। সংসার ঠিক রাখতে গিয়ে একরকম শ্রমিকে পরিণত হয়েছে। গ্রীষ্মের উগ্র আর খিটখিটে হবার পেছনে এটাও একটা কারণ। সংসারের এতো চাপ সহ্য করেও সে নিজেকে ঠিক রেখেছে। এতো বড় সংসার সামলাতে সামলাতে তাই তাকে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি বয়স্ক মনে হয়। শীত জানে, সে তার দাদার মতো হতে পারেনি, তাই এমন মনমরা হয়ে থাকে, আর এভাবেই নিঃস্ব একদিন।
সবার ছোট বসন্ত। আলালের ঘরে দুলাল। সংসারের কোন কাজকর্ম তাকে ছুঁতেও পারে না। সবাই ভীষণ আদর করে। সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে। সংসারের সব উপার্জন যেন শুধু তার জন্যই। বসন্তের মুখ দেখে যে যার দুঃখ ভুলে থাকতে পারে। ওর মিষ্টি মুখের কচি হাসি সংসারটাকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে। তার জন্য ফুল পাখি নদী আকাশ সবকিছুই উপহার হয়ে আসে। যদিও বসন্ত তার নাম, তবু সবাই বাসন্তী বলে ডাকতেই ভালোবাসে। মেয়ের মতোই তার আদর। সব আবদার মেনে নিতে পিছু হটে না কেউ।
______________________________________________________________
No comments:
Post a Comment