নিবন্ধ
ভাষা, দৃষ্টি আর পাঠের মধ্য দিয়েই একজন লেখকের আত্মপ্রকাশ। সম্পাদনার কাজটি বলেন-ওই একই কথা। সম্পাদনা অন্যতম সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। না জেনে এখানে থিতু হওয়া যায় না বরং ভুলভাল মানসিকতায় সম্পাদকের চেয়ারে বসা মানে মানুষের কাছে বিষটি হাস্যকর হয়ে যাওয়া। প্রত্যেক মানুষ তার নিজস্ব ভাষা আর দৃষ্টি শক্তি দিয়ে একটি সমাজ আর রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। তেমনি প্রকৃতি আর কল্পনাকেও ধারন করতে হবে মস্তিষ্কের ভেতর দিয়ে। তবেই কারুকাজের সৌন্দর্যে আপনি একটি সুন্দর সৃষ্টি আপনার মতোকরে সমাজকে উপহার দিতে পারবেন। অর্থাৎ এই দুই আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই মূলত ফুটে উঠে সমাজ ও রাষ্ট্রে একজন সৃষ্টিশীলের সুন্দর চেহারা। আবার অনেক সৃষ্টিশীল রয়েছেন— একজীবনে নিজ আত্মা ও দেহ ক্ষয় করে ভালো একটি কাজ সৃষ্টির লক্ষ্যে অপেক্ষা করতে করতে দেহের ঘাম ঝরান দ্বিগুণ! অথচ তার ফল হয় উল্টো।
যেমন একজন কৃষক চামড়া ঘষে হাড্ডির উপর লড়াই করে অন্ন বাঁচিয়ে রাখেন পৃথিবী আর মানুষের জন্য। আমরা এই মহান কৃষকদের চাষি না বলে বা না ডেকে, কৃষিস্রষ্টা ডাকতে পারি। এবং গোটা বিশ্বের সেরা কৃষিস্রষ্টা নির্বাচন করে আমরা তাদের হাতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো ও দামি পুরস্কারটি তুলে দেয়ার ধারাবাহিকতা রাখলে, উচ্চ শিক্ষিত-শিক্ষার্থীরাও এই কৃষিখাতায় ‘ কৃষকস্রষ্টা হতে নাম লেখাবে আপনমনে। কারণ কৃষক শেকড় থেকে তুলে আনেন তার সৃষ্টিকে কেবল আমাদের জন্যই।
সাহিত্য আর যাই হোক ঘোষণা দিয়ে হয় না। আগে সাহিত্য পাঠ করতে হয়। লালন করতে হয় বুকে। সাহিত্যের জন্য আত্মা ক্ষয় করতে হয় এবং জীবন চলার সময় নষ্ট করে এই পথে হাঁটতে হয়। এখানে ধান্দা নেই-থাকতে হবে মহত উদ্দেশ্য। তবেই আপনি কিঞ্চিৎ হলেও সফলতা পাবেন। আর এটাও সত্য— সাহিত্য সম্পাদনাটাও কম খাটুনির বিষয় নয়, সাহিত্য সম্পাদনা করতে হলে আর যাই হোক, সাহিত্য ভালো করে জেনে আপনাকে এখানে পা রাখতে হবে। খামখা একটা শিরোনাম বসিয়ে দিলে আর যাই হোক-অন্তত সাহিত্যের ক্ষেত্রে এটা কখনোই চলে না, চলবে না। সাহিত্যের জন্য সবার আগে মন পরিষ্কার রাখতে হয়। দেহকে শতভাগ ঠিক রাখতে হয়। মস্তিষ্ক ক্ষয় করে, সময় ও মেধা আর দেহের ঘাম ঝরাতে পারলেই আপনি একটু হলেও ভালো সম্পাদনা করতে পারবেন। নচেৎ হুদাহুদি নাম দেখানো কামের প্রয়োজন নাই।
দুই.
অবশ্য এখানে নতুন বা পুরনো বলে কোনো কথা নেই। ইতিহাস আমাদের পক্ষে। যেখানে প্রত্যেক সৃষ্টিশীল মানে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্ধী। আর সবকিছুরই একটা চেষ্টার উপস্থিতি ঘটে। আদিকালে যেমন যৌবনওয়ালারা যুবতীদের দেখে দেখে লালা হজম করতো—এখন কিন্তু সে দৃশ্য নেই। পৃথিবীর রঙের সাথে মানুষের কৌশলটাও পাল্টাচ্ছে বা পাল্টে গেছে। এখন হুট করে কেউ কিছু করে না। মানুষ গভীর চিন্তায় নিমগ্ন আর জ্ঞানের মধ্য দিয়ে প্রথম নয় দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার চর্চা করে হলেও কিভাবে নিজ চিন্তা ও জ্ঞানদ্বারা একটি পরিপূর্ণ কাজ উপহার দিবে সমাজকে। আবার সব চিন্তা যে পূর্ণতা পাবে এমন নয়, মানুষের ব্যর্থতা জন্ম থেকে এবং তা থাকে মৃত্যু অবধি। আর সে ব্যর্থতাকে স্বীকার করে মানুষ পুনরায় শুরু করে দেন নতুন কাজে। এবং এখানে সে নিজেকে মেলে ধরতে বেশি বেগ পেতে হয় না। কারণ তার সাধনায়ই তাকে দ্বিতীয়বার সে সুযোগ করে দেয়। আবার আমরা যে যেটা বলি না কেনো-প্রত্যেক কাজের শুরুতে একটা একপ্রকার গবেষণার মাধ্যমে আবিষ্কারের পথ তৈরি করতে হয়। না হয় সৃষ্টির পথে হাঁটা মানুষগুলো পুনরায় পেছন থেকে সামনে আসতে সময় লেগে যায় দীর্ঘ। আর এখানেই যার যার মতো করে অভীষ্ট এক নতুন পথে পৌঁছাতে সক্ষম হয় মানুষ। অবশ্য এখানে বাধা দেয়ার কিছু নেই। কারণ সব সৃষ্টিশীলেরাই ওই পথগুলো অতিক্রম করে এই সৃষ্টির পথে পা রাখেন। অর্থাৎ আপনি স্বীকার করতে কোনো লজ্জা নেই যে, সকল সৃষ্টির জন্য আপনাকে প্রথমত সৎ হতে হবে। দ্বিতীয়ত পাঠের মধ্যে থেকে আপনাকে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আর চিন্তার গভীরতা বাড়াতে পারলেই আপনি নতুন একটি কাজ সামনে তুলে ধরতে পারবেন সহজে। না হয় দশ টাকায় ফুটপাতে সেভ করে স্যুটটাই পরে আরামদায়ক কেদারায় বসে বসে ‘ঘোষণা‘ দিলেই নিজের সৃষ্টির কাজটি হয়ে যায় না এবং তা কখনোই হবে না। আর হলেও তা কখনও নিজের মধ্যে দীর্ঘ সময় জিইয়ে থাকে না। কেনো জানি পালিয়ে যায়, কেনো জানি ভুল হয়ে যায়। এভাবেই একজন প্রকৃত স্রষ্টা নিজের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে শেকড় থেকে তুলে এনে চর্চা করে এক নতুন সংস্কৃতি। আর এখানেই তার কাজের প্রতিক্রিয়া দেখে, তাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা যায় এবং অন্যরা হাত তালি দেয়।
তিন.
যে সমাজে আমাদের বাস কিংবা যে শহরে কর্ম করি, আড্ডা দিই খাই-ঘুমাই, আসলে কি আমরা আন্তরিক হচ্ছি? জ্ঞানীকে শ্রদ্ধা করছি? না, এসবের কিছুই করছি না আমরা। আর করছি না বলে আমরা রোমান্টিসিজম নিজেরাই নিজেরদের বড় করে তুলছি। হাত তালি দিচ্ছি সস্তা কথায়। অথচ দেখুন, আমি কিছুই নই। কে বা আমাকে চেনে? কে আমাকে ডাকে? কার কাছে কতটুকু আমি গুরুত্বপূর্ণ? এভাবেই প্রত্যেকটা মানুষের উপর এমন সহজ প্রশ্ন থেকে যায় দশকে দশকে। যা কখনো সুউত্তর মেলে না। কারণ আন্তরিক হচ্ছে একটা শিল্প। আর জ্ঞান হচ্ছে ঈশ্বরের ছায়া। লালন সাঁই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, গৌতম বুদ্ধ, তাঁরা আজকের সময়ে একেকটা প্রতিষ্ঠান। তাঁরা আন্তরিক ছিলেন এবং জ্ঞান জগতেও তাঁরা একেকজন সমৃদ্ধ। তাই তাঁরা সৎ ও শিল্পসৃষ্টির মধ্য দিয়ে একেকজন স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন মানুষের অন্তরে।
আবার শিল্পও কোনো সমালোচনা করে প্রতিষ্ঠা পায় না। কিংবা একটি রোমান্টিক কবিতা বা প্রেমের গল্প লিখে ফেললেই লেখক হওয়া যায় না। অথবা বড় অক্ষরে নাম বসিয়ে দিলে আমি অমুক পত্রিকার সম্পাদক, তাও হওয়া যায় না। শিল্প করলে-আগে শিল্পকে হৃদয় দিয়ে আপন করে নিতে হয়। লালন করতে হয় নিজ দেহে। শিল্পকে পুজো করতে হয়। একজন সাংবাদিক বা সম্পাদক কী, সম্পাদনার অর্থটা কী, তা স্পষ্ট কাগজে ছাপ থাকতে হবে। কাগজে নাম থাকলেই যে সম্পাদক কিংবা সাংবাদিক হয়ে যাবে এমন নয়। একজন সম্পাদক ও সাংবাদিককে মূলত সংবাদ পাঠকরাই আবিষ্কার করে নেয়। আর সে আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে একজন সাংবাদিক বা সম্পাদক খ্যাতি অর্জন করেন। সাংবাদিকতার নাম করে কেবল নতুন স্যুটটাই পড়ে, মুখে ক্লিন সেভ করলে তো ভাই যে কেউ সাংবাদিক বনে যায় না। এটা তো সস্তা জিনিস নয় যে, সম্পাদক নিউজের প্রতিটা লাইন-শিরোনাম কি হতে পারে, প্রতিটা শব্দের সাথে যে ঘাটাঘাটি করে সে তো প্রকৃত সম্পাদক। আর লালন সাঁই, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কি গৌতম বুদ্ধদের মতো জ্ঞান অর্জন করতে হবে। সাথে চর্চা করতে হবে এবং এঁদের গভীর পাঠ নিতে হবে। তবেই তো আপনি আন্তরিক হয়ে উঠবেন। তা না হলে আমরা কেউই সৃষ্টির চূড়ায় হাঁটতে পারবো না। হিংসাঘরে বন্দী হয়ে আমাদের চিড়া-মুড়ি কষা ছাড়া আর কিছুই করার থাকেব না। সুতরাং না পারবো আমি আপনার কাছে শিখতে, না পারবো আমি আপনার আন্তরিক হয়ে উঠতে। ঐ যে অস্থায়ী কলাগাছের ভেলার মতো জলের উপর কেবল সাঁতারই কাটতে থাকবো যুগের পর যুগ আমরা।
চার.
সবার জীবনেই একজন শিক্ষক, গুরু অথবা পথপ্রর্দশকের প্রয়োজন থাকে। আপনি মানেন বা না মানেন, তা একান্তই আপনার ব্যাপার। তবে সত্য যে চির অম্লান তা কে আছে অস্বীকার করার। আপনি টিকিট কেটেছেন, গাড়িতে উঠেছেন, যাত্রা শুরু করেছেন আপনার ঠিকানায় অথবা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু যে জায়গায় যাচ্ছেন তার আগে তো আপনি ঠিক ঠিক জেনে শুনে বুঝে প্রস্তুত হয়েছেন যে কোথায় যাবেন। তার জন্য অবশ্যই আপনি কারো কাছ থেকে একটু হলেও পরামর্শ নিয়েছেন। আর সে পরামর্শটাই হচ্ছে ‘প্রয়োজন‘ আর এই প্রয়োজনদ্বারা আপনার চিন্তাকে সমন্নয় করে তোলে নিজের দিক ভবিষ্যত। কোনো শিক্ষক, গুরুজি আপনার হাত ধরে আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিবে না। এটা কখনও সম্ভবও নয়। গুরু আপনাকে পথের রেখা বাতলে দিবে। সত্য মিথ্যার মিথ আপনার সমনে যুক্তিসহকারে উপস্থাপন করবে মাত্র। আর সেখান থেকে খারাপ-ভালো আপনি যেটাই গ্রহণ করুন তাতে একজন শিক্ষক অথবা গুরুজনের কিছুই যায় আসে না। বরং আপনাকে নিজ পায়ে আপনার যাত্রায় পৌঁছতে হবে। সে ভ্রমণ যাত্রায় আপনার মস্তিষ্কে অবশ্যই আদর্শতার খাতিরে রাখতে হবে—আপনারই পথপ্রর্দশককে।
একটা জীবন বাঁচাতে মানুষ সংগ্রাম করে এক শ বছর কিংবা তারও বেশি। কিন্তু এই সংগ্রামটা কতটুকু স্থায়ী হচ্ছে সেটা দেখার গুরুত্বটা বেশি। অথচ এক শ বছরের সে দীর্ঘ স্বপ্নটা আমরা এক শ মিনিটও লালন করি না! আর করি না বলে এখানেই আমাদের ব্যর্থতা ফুটে উঠে। ঠিক তখনি ব্যর্থতা দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয় দীর্ঘ পথ। এই যাত্রাও ঠিক দীর্ঘ সময় থাকে না। ভুল আর ভুল পথে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের আয়ু কেবল শ্মশানের দিনে ধাবিত হয়! এটা মোটেও মিথ্যে নয়-বরং একটা দীর্ঘ স্বপ্নের খোঁজে আমাদের আত্মা, আঁধার রাতকে ডাকে বারংবার। কারণ একটাই, শ্মশানঘাট নয়— একটা চাঁদের আলোয় সে নিজ আত্মাকে সামনে দাঁড় করাতে চায় মাত্র। কিন্তু পারে না। ওই যে প্রকৃতি, প্রকৃতির সাথে কখনও প্রতিদ্ব›দ্বী করতে নেই। অপ্রতিদ্ব›দ্বীতার মাঝে থাকতে হয় পৃথিবী ও মানুষকে। কারণ প্রকৃতি আর পৃথিবী এক নয়। পৃথিবীকে দেখা গেলেও, প্রকৃতি কিন্তু বরাবরই অদৃশ্য-শক্তিমান। আর মানুষ এই প্রকৃতির কাছেই চিরকাল অসহায়। তবু মানুষ দূর্ঘটনার মধ্য দিয়েই জন্মগ্রহণ করে। তারপর সে মানুষ শুরুতেই চিৎকারে চিৎকারে জানান দেয়, আমি সুখি নই। আমার কষ্টটাই আমাকে কাঁদাচ্ছে! হাসিটাও দীর্ঘ থাকে না। জানালার আড়ালে ভূতের ভয়! ভয় কাটাতে গলায় তাবিজ। এভাবেই মানুষ শিশু থেকে ভয়ের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে শিখে সাথে পায়ে পায়ে বড়ো হয়। আর মাঝখানে আনন্দ ও হাসি এক আধটু খেলা করলেও বলা যায় হাসিরাও কারণ বুঝে হাসে। অর্থাৎ সব হাসিরই একটা স্বার্থ থাকে। আপনি আমি যাই বলি না কেনো, হাসি আর কান্না বলতে কোনো ঘর নেই। মূলত কান্নাটাই মানুষের ছায়া হয়ে শ্মশানঘাট পর্যন্ত জিইয়ে রয়। অন্যসব আস্তে আস্তে একা হয়ে যায়। এবং দ্রুত তা আড়ালও হয়ে পড়ে। এই পরার মধ্য দিয়ে এক শ বছর হওয়ার আগে আমাদের জীবন পুরো-পুরি পূর্ণতা পায় না। কারণ, প্রত্যেক সৃষ্টিশীল মানুষ ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্ধী হলেও হীনমন্যতার মধ্যে জীবন পার করা একমাত্র প্রাণী হিসেবে, অপূর্ণ কেবল আমরাই।
_____________________________________________________________________
আলমগীর মাসুদ | জন্ম ১১ জানুয়ারি ১৯৯০, ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলাধীন দক্ষিণ ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী বিলোনিয়া।পেশায় সাংবাদিক, আগ্রহ মূলত কথা সাহিত্যে।২০০৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, সাহিত্যপত্র, লিটলম্যাগ ও অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর গল্প ও প্রবন্ধ।সম্পাদক -ভাটিয়াল (ত্রৈমাসিক সাহিত্যের কাগজ)|
আ ল ম গী র মা সু দ
প্রত্যেক সৃষ্টিশীল মানুষ ঈশ্বরের
প্রতিদ্বন্দ্ধী..অপূর্ণ কেবল হীনমন্যওয়ালারা
ভাষা, দৃষ্টি আর পাঠের মধ্য দিয়েই একজন লেখকের আত্মপ্রকাশ। সম্পাদনার কাজটি বলেন-ওই একই কথা। সম্পাদনা অন্যতম সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। না জেনে এখানে থিতু হওয়া যায় না বরং ভুলভাল মানসিকতায় সম্পাদকের চেয়ারে বসা মানে মানুষের কাছে বিষটি হাস্যকর হয়ে যাওয়া। প্রত্যেক মানুষ তার নিজস্ব ভাষা আর দৃষ্টি শক্তি দিয়ে একটি সমাজ আর রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। তেমনি প্রকৃতি আর কল্পনাকেও ধারন করতে হবে মস্তিষ্কের ভেতর দিয়ে। তবেই কারুকাজের সৌন্দর্যে আপনি একটি সুন্দর সৃষ্টি আপনার মতোকরে সমাজকে উপহার দিতে পারবেন। অর্থাৎ এই দুই আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই মূলত ফুটে উঠে সমাজ ও রাষ্ট্রে একজন সৃষ্টিশীলের সুন্দর চেহারা। আবার অনেক সৃষ্টিশীল রয়েছেন— একজীবনে নিজ আত্মা ও দেহ ক্ষয় করে ভালো একটি কাজ সৃষ্টির লক্ষ্যে অপেক্ষা করতে করতে দেহের ঘাম ঝরান দ্বিগুণ! অথচ তার ফল হয় উল্টো।
যেমন একজন কৃষক চামড়া ঘষে হাড্ডির উপর লড়াই করে অন্ন বাঁচিয়ে রাখেন পৃথিবী আর মানুষের জন্য। আমরা এই মহান কৃষকদের চাষি না বলে বা না ডেকে, কৃষিস্রষ্টা ডাকতে পারি। এবং গোটা বিশ্বের সেরা কৃষিস্রষ্টা নির্বাচন করে আমরা তাদের হাতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো ও দামি পুরস্কারটি তুলে দেয়ার ধারাবাহিকতা রাখলে, উচ্চ শিক্ষিত-শিক্ষার্থীরাও এই কৃষিখাতায় ‘ কৃষকস্রষ্টা হতে নাম লেখাবে আপনমনে। কারণ কৃষক শেকড় থেকে তুলে আনেন তার সৃষ্টিকে কেবল আমাদের জন্যই।
সাহিত্য আর যাই হোক ঘোষণা দিয়ে হয় না। আগে সাহিত্য পাঠ করতে হয়। লালন করতে হয় বুকে। সাহিত্যের জন্য আত্মা ক্ষয় করতে হয় এবং জীবন চলার সময় নষ্ট করে এই পথে হাঁটতে হয়। এখানে ধান্দা নেই-থাকতে হবে মহত উদ্দেশ্য। তবেই আপনি কিঞ্চিৎ হলেও সফলতা পাবেন। আর এটাও সত্য— সাহিত্য সম্পাদনাটাও কম খাটুনির বিষয় নয়, সাহিত্য সম্পাদনা করতে হলে আর যাই হোক, সাহিত্য ভালো করে জেনে আপনাকে এখানে পা রাখতে হবে। খামখা একটা শিরোনাম বসিয়ে দিলে আর যাই হোক-অন্তত সাহিত্যের ক্ষেত্রে এটা কখনোই চলে না, চলবে না। সাহিত্যের জন্য সবার আগে মন পরিষ্কার রাখতে হয়। দেহকে শতভাগ ঠিক রাখতে হয়। মস্তিষ্ক ক্ষয় করে, সময় ও মেধা আর দেহের ঘাম ঝরাতে পারলেই আপনি একটু হলেও ভালো সম্পাদনা করতে পারবেন। নচেৎ হুদাহুদি নাম দেখানো কামের প্রয়োজন নাই।
দুই.
অবশ্য এখানে নতুন বা পুরনো বলে কোনো কথা নেই। ইতিহাস আমাদের পক্ষে। যেখানে প্রত্যেক সৃষ্টিশীল মানে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্ধী। আর সবকিছুরই একটা চেষ্টার উপস্থিতি ঘটে। আদিকালে যেমন যৌবনওয়ালারা যুবতীদের দেখে দেখে লালা হজম করতো—এখন কিন্তু সে দৃশ্য নেই। পৃথিবীর রঙের সাথে মানুষের কৌশলটাও পাল্টাচ্ছে বা পাল্টে গেছে। এখন হুট করে কেউ কিছু করে না। মানুষ গভীর চিন্তায় নিমগ্ন আর জ্ঞানের মধ্য দিয়ে প্রথম নয় দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার চর্চা করে হলেও কিভাবে নিজ চিন্তা ও জ্ঞানদ্বারা একটি পরিপূর্ণ কাজ উপহার দিবে সমাজকে। আবার সব চিন্তা যে পূর্ণতা পাবে এমন নয়, মানুষের ব্যর্থতা জন্ম থেকে এবং তা থাকে মৃত্যু অবধি। আর সে ব্যর্থতাকে স্বীকার করে মানুষ পুনরায় শুরু করে দেন নতুন কাজে। এবং এখানে সে নিজেকে মেলে ধরতে বেশি বেগ পেতে হয় না। কারণ তার সাধনায়ই তাকে দ্বিতীয়বার সে সুযোগ করে দেয়। আবার আমরা যে যেটা বলি না কেনো-প্রত্যেক কাজের শুরুতে একটা একপ্রকার গবেষণার মাধ্যমে আবিষ্কারের পথ তৈরি করতে হয়। না হয় সৃষ্টির পথে হাঁটা মানুষগুলো পুনরায় পেছন থেকে সামনে আসতে সময় লেগে যায় দীর্ঘ। আর এখানেই যার যার মতো করে অভীষ্ট এক নতুন পথে পৌঁছাতে সক্ষম হয় মানুষ। অবশ্য এখানে বাধা দেয়ার কিছু নেই। কারণ সব সৃষ্টিশীলেরাই ওই পথগুলো অতিক্রম করে এই সৃষ্টির পথে পা রাখেন। অর্থাৎ আপনি স্বীকার করতে কোনো লজ্জা নেই যে, সকল সৃষ্টির জন্য আপনাকে প্রথমত সৎ হতে হবে। দ্বিতীয়ত পাঠের মধ্যে থেকে আপনাকে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আর চিন্তার গভীরতা বাড়াতে পারলেই আপনি নতুন একটি কাজ সামনে তুলে ধরতে পারবেন সহজে। না হয় দশ টাকায় ফুটপাতে সেভ করে স্যুটটাই পরে আরামদায়ক কেদারায় বসে বসে ‘ঘোষণা‘ দিলেই নিজের সৃষ্টির কাজটি হয়ে যায় না এবং তা কখনোই হবে না। আর হলেও তা কখনও নিজের মধ্যে দীর্ঘ সময় জিইয়ে থাকে না। কেনো জানি পালিয়ে যায়, কেনো জানি ভুল হয়ে যায়। এভাবেই একজন প্রকৃত স্রষ্টা নিজের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে শেকড় থেকে তুলে এনে চর্চা করে এক নতুন সংস্কৃতি। আর এখানেই তার কাজের প্রতিক্রিয়া দেখে, তাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা যায় এবং অন্যরা হাত তালি দেয়।
তিন.
যে সমাজে আমাদের বাস কিংবা যে শহরে কর্ম করি, আড্ডা দিই খাই-ঘুমাই, আসলে কি আমরা আন্তরিক হচ্ছি? জ্ঞানীকে শ্রদ্ধা করছি? না, এসবের কিছুই করছি না আমরা। আর করছি না বলে আমরা রোমান্টিসিজম নিজেরাই নিজেরদের বড় করে তুলছি। হাত তালি দিচ্ছি সস্তা কথায়। অথচ দেখুন, আমি কিছুই নই। কে বা আমাকে চেনে? কে আমাকে ডাকে? কার কাছে কতটুকু আমি গুরুত্বপূর্ণ? এভাবেই প্রত্যেকটা মানুষের উপর এমন সহজ প্রশ্ন থেকে যায় দশকে দশকে। যা কখনো সুউত্তর মেলে না। কারণ আন্তরিক হচ্ছে একটা শিল্প। আর জ্ঞান হচ্ছে ঈশ্বরের ছায়া। লালন সাঁই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, গৌতম বুদ্ধ, তাঁরা আজকের সময়ে একেকটা প্রতিষ্ঠান। তাঁরা আন্তরিক ছিলেন এবং জ্ঞান জগতেও তাঁরা একেকজন সমৃদ্ধ। তাই তাঁরা সৎ ও শিল্পসৃষ্টির মধ্য দিয়ে একেকজন স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন মানুষের অন্তরে।
আবার শিল্পও কোনো সমালোচনা করে প্রতিষ্ঠা পায় না। কিংবা একটি রোমান্টিক কবিতা বা প্রেমের গল্প লিখে ফেললেই লেখক হওয়া যায় না। অথবা বড় অক্ষরে নাম বসিয়ে দিলে আমি অমুক পত্রিকার সম্পাদক, তাও হওয়া যায় না। শিল্প করলে-আগে শিল্পকে হৃদয় দিয়ে আপন করে নিতে হয়। লালন করতে হয় নিজ দেহে। শিল্পকে পুজো করতে হয়। একজন সাংবাদিক বা সম্পাদক কী, সম্পাদনার অর্থটা কী, তা স্পষ্ট কাগজে ছাপ থাকতে হবে। কাগজে নাম থাকলেই যে সম্পাদক কিংবা সাংবাদিক হয়ে যাবে এমন নয়। একজন সম্পাদক ও সাংবাদিককে মূলত সংবাদ পাঠকরাই আবিষ্কার করে নেয়। আর সে আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে একজন সাংবাদিক বা সম্পাদক খ্যাতি অর্জন করেন। সাংবাদিকতার নাম করে কেবল নতুন স্যুটটাই পড়ে, মুখে ক্লিন সেভ করলে তো ভাই যে কেউ সাংবাদিক বনে যায় না। এটা তো সস্তা জিনিস নয় যে, সম্পাদক নিউজের প্রতিটা লাইন-শিরোনাম কি হতে পারে, প্রতিটা শব্দের সাথে যে ঘাটাঘাটি করে সে তো প্রকৃত সম্পাদক। আর লালন সাঁই, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কি গৌতম বুদ্ধদের মতো জ্ঞান অর্জন করতে হবে। সাথে চর্চা করতে হবে এবং এঁদের গভীর পাঠ নিতে হবে। তবেই তো আপনি আন্তরিক হয়ে উঠবেন। তা না হলে আমরা কেউই সৃষ্টির চূড়ায় হাঁটতে পারবো না। হিংসাঘরে বন্দী হয়ে আমাদের চিড়া-মুড়ি কষা ছাড়া আর কিছুই করার থাকেব না। সুতরাং না পারবো আমি আপনার কাছে শিখতে, না পারবো আমি আপনার আন্তরিক হয়ে উঠতে। ঐ যে অস্থায়ী কলাগাছের ভেলার মতো জলের উপর কেবল সাঁতারই কাটতে থাকবো যুগের পর যুগ আমরা।
চার.
সবার জীবনেই একজন শিক্ষক, গুরু অথবা পথপ্রর্দশকের প্রয়োজন থাকে। আপনি মানেন বা না মানেন, তা একান্তই আপনার ব্যাপার। তবে সত্য যে চির অম্লান তা কে আছে অস্বীকার করার। আপনি টিকিট কেটেছেন, গাড়িতে উঠেছেন, যাত্রা শুরু করেছেন আপনার ঠিকানায় অথবা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু যে জায়গায় যাচ্ছেন তার আগে তো আপনি ঠিক ঠিক জেনে শুনে বুঝে প্রস্তুত হয়েছেন যে কোথায় যাবেন। তার জন্য অবশ্যই আপনি কারো কাছ থেকে একটু হলেও পরামর্শ নিয়েছেন। আর সে পরামর্শটাই হচ্ছে ‘প্রয়োজন‘ আর এই প্রয়োজনদ্বারা আপনার চিন্তাকে সমন্নয় করে তোলে নিজের দিক ভবিষ্যত। কোনো শিক্ষক, গুরুজি আপনার হাত ধরে আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিবে না। এটা কখনও সম্ভবও নয়। গুরু আপনাকে পথের রেখা বাতলে দিবে। সত্য মিথ্যার মিথ আপনার সমনে যুক্তিসহকারে উপস্থাপন করবে মাত্র। আর সেখান থেকে খারাপ-ভালো আপনি যেটাই গ্রহণ করুন তাতে একজন শিক্ষক অথবা গুরুজনের কিছুই যায় আসে না। বরং আপনাকে নিজ পায়ে আপনার যাত্রায় পৌঁছতে হবে। সে ভ্রমণ যাত্রায় আপনার মস্তিষ্কে অবশ্যই আদর্শতার খাতিরে রাখতে হবে—আপনারই পথপ্রর্দশককে।
একটা জীবন বাঁচাতে মানুষ সংগ্রাম করে এক শ বছর কিংবা তারও বেশি। কিন্তু এই সংগ্রামটা কতটুকু স্থায়ী হচ্ছে সেটা দেখার গুরুত্বটা বেশি। অথচ এক শ বছরের সে দীর্ঘ স্বপ্নটা আমরা এক শ মিনিটও লালন করি না! আর করি না বলে এখানেই আমাদের ব্যর্থতা ফুটে উঠে। ঠিক তখনি ব্যর্থতা দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয় দীর্ঘ পথ। এই যাত্রাও ঠিক দীর্ঘ সময় থাকে না। ভুল আর ভুল পথে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের আয়ু কেবল শ্মশানের দিনে ধাবিত হয়! এটা মোটেও মিথ্যে নয়-বরং একটা দীর্ঘ স্বপ্নের খোঁজে আমাদের আত্মা, আঁধার রাতকে ডাকে বারংবার। কারণ একটাই, শ্মশানঘাট নয়— একটা চাঁদের আলোয় সে নিজ আত্মাকে সামনে দাঁড় করাতে চায় মাত্র। কিন্তু পারে না। ওই যে প্রকৃতি, প্রকৃতির সাথে কখনও প্রতিদ্ব›দ্বী করতে নেই। অপ্রতিদ্ব›দ্বীতার মাঝে থাকতে হয় পৃথিবী ও মানুষকে। কারণ প্রকৃতি আর পৃথিবী এক নয়। পৃথিবীকে দেখা গেলেও, প্রকৃতি কিন্তু বরাবরই অদৃশ্য-শক্তিমান। আর মানুষ এই প্রকৃতির কাছেই চিরকাল অসহায়। তবু মানুষ দূর্ঘটনার মধ্য দিয়েই জন্মগ্রহণ করে। তারপর সে মানুষ শুরুতেই চিৎকারে চিৎকারে জানান দেয়, আমি সুখি নই। আমার কষ্টটাই আমাকে কাঁদাচ্ছে! হাসিটাও দীর্ঘ থাকে না। জানালার আড়ালে ভূতের ভয়! ভয় কাটাতে গলায় তাবিজ। এভাবেই মানুষ শিশু থেকে ভয়ের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে শিখে সাথে পায়ে পায়ে বড়ো হয়। আর মাঝখানে আনন্দ ও হাসি এক আধটু খেলা করলেও বলা যায় হাসিরাও কারণ বুঝে হাসে। অর্থাৎ সব হাসিরই একটা স্বার্থ থাকে। আপনি আমি যাই বলি না কেনো, হাসি আর কান্না বলতে কোনো ঘর নেই। মূলত কান্নাটাই মানুষের ছায়া হয়ে শ্মশানঘাট পর্যন্ত জিইয়ে রয়। অন্যসব আস্তে আস্তে একা হয়ে যায়। এবং দ্রুত তা আড়ালও হয়ে পড়ে। এই পরার মধ্য দিয়ে এক শ বছর হওয়ার আগে আমাদের জীবন পুরো-পুরি পূর্ণতা পায় না। কারণ, প্রত্যেক সৃষ্টিশীল মানুষ ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্ধী হলেও হীনমন্যতার মধ্যে জীবন পার করা একমাত্র প্রাণী হিসেবে, অপূর্ণ কেবল আমরাই।
_____________________________________________________________________
No comments:
Post a Comment