প্রবন্ধ
জা হি দ রু দ্র
বিলুপ্তির পথে নাগরী ভাষা
ভাষা হচ্ছে একটি জাতির নির্ণায়ক উপাদান। পৃথিবীতে প্রথম মানুষের বিকাশ হয়েছে ভাষাহীন যুথবুদ্ধি প্রাণী হিসেবে। তারপর ক্রমশ শ্রম প্রচেষ্টায় হাত এবং সবশেষে আঙ্গুলের সূক্ষ্ম ব্যবহারের মাধ্য দিয়ে মস্তিষ্কের সেরিব্র্যাল কর্টেক্সের বিকাশের ফলে,সুবিধা ও সহযোগিতা মূলক জীবন নিশ্চিতির চেষ্টায় অর্থ,ভাব ও উদ্দেশ্য বিনিময়ের লক্ষ্যে বস্তু, বিষয়,ও ঘটনার শাব্দিক প্রকাশের উদ্ভব তাঁদের ব্যবহারের নিয়ম বিকশিত হয়েছে। আজ থেকে প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগে মানুষের পূর্বপুরুষ প্রাণীটি শিম্পাঞ্জিদের পূর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে এই প্রাণীগুলোর ভাষা ছিল তুলনামূলক ভাবে বেশ উন্নত।কিন্তু মানুষদের এই আদি পূর্বপুরুষদের ভাষার প্রকৃতি সম্পর্কে খুব কমই জানতে পারা গেছে। পৃথিবীর সকল মানুষ অখণ্ড মানবতার অংশ হলেও ভিন্ন ভিন্ন যে সমস্ত ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক উদ্দীপনার প্রতি সাড়া দিয়ে প্রতিক্রিয়া ও অভিযোজনের মধ্য দিয়ে তারা ভিন্ন ভিন্ন নৃগোষ্ঠী ও জনজাতিতে বিকশিত হয়েছে। তার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে তাদের ভিন্ন ভিন্ন ভাষা।
সিলেটের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নিজস্ব স্বকীয়তার এক বড় উদাহরণ হল 'নাগরী ভাষা'। বর্তমানে ভাষাটি নতুন প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্পের আকার নিয়েছে এবং ইহার ব্যবহার অস্তাচলে গিয়েছে। তবে এটি এমন এক ব্যাতিক্রমী ভাষা যাহার লিপি আছে কিন্তু ভাষাটি হারিয়ে গিয়েছে। নিজস্ব ভাষার অধিকারী, সিলেটি নাগরী ভাষা বাংলা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং প্রাচীন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষা এই তথ্য প্রায় সিলেটিদের অজানা। তাই সিলেটি ভাষা আজ উপেক্ষিত। সিলেটিদের নিজস্ব লিপি নাগরী আজ লুপ্ত প্রায়।
পৃথিবীতে প্রায় আট হাজার ভাষা আছে। এরমধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষার সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। এই তিন হাজার ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা আছে এবং যা মানুষের মুখে উচ্চারিত রয়েছে। বিশ্বের স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষার মধ্যে সিলেটি 'নাগরি' ও একটি। গবেষকদের মতে এই ভাষার সীমাবদ্ধতা শুধু বাংলাদেশে নয় বরং ইহা ভারতের অসম রাজ্যের কাছাড়, করিমগঞ্জ,হাইলাকান্দি,ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের বহু সংখ্যক লোকের মাতৃভাষা সিলেটি। তাই বাঙালি হিসেবে যদিও মাতৃভাষা বাংলা কিন্তু সিলেটিদের ছিল প্রাচীন নাগরী। ফ্রান্সের বিখ্যাত ভাষা যাদুঘরে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার উদৃতি রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ দুটি ভাষার বিষয়ে উল্লেখ আছে। এর একটি বাংলা আরেকটি নাগরী। নাগরী ভাষা নিয়ে দেশে বিদেশে চলছে গবেষণা। কিন্তু প্রাচীন এই ভাষাটির এখনও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। এই ভাষার উপর গবেষণা, পি,এইচ,ডি নেওয়া হচ্ছে বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ব্রিটেনে সিলেটি ভাষা শিক্ষার কয়েকটি ইনস্টিটিউট থাকলেও আমাদের অঞ্চলে সিলেটি ভাষা শিখার কোনো ক্ষেত্র নেই। ইহা খুবই পরিতাপের বিষয়। যার ফলে সিলেটি ভাষা মানুষের মুখে থাকলেও এর বর্ণমালা অনেকটা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হারিয়ে যাচ্ছে এর ইতিহাসও।
এই নাগরী চর্চা ও গবেষণা হলে অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সন্ধান পাওয়া যাবে। এই ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস থেকে জানা যায় জটিল সংস্কৃতি প্রধান বাংলা বর্ণমালার বিকল্প লিপি হিসেবে সিলেটি নাগরী লিপির উদ্ভাবন হয়েছিল খ্রিষ্ট্রীয় চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। গবেষকদের ধারণা ইসলাম প্রচারক সুফি সাধক হজরত শাহজালাল (রঃ) সঙ্গে ৩৬০ আউলিয়া সিলেটে আসেন বিভিন্ন দেশ ও এই উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চল থেকে। তাদের প্রচলিত ভাষা বাংলা ছিল না, তাই এই অঞ্চলের মানুষের সাথে ভাব বিনিময়ের জন্য একটি ভাষা চর্চার শুরু হয় এবং পরবর্তীতে ইহা নাগরী ভাষা নামে পরিচিতি লাভ করে।
বৃহত্তর সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদী তীরবর্তী হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার এবং সুনামগঞ্জ এই চারটি জেলার মানুষ ছাড়া ভারতের বরাক নদী তীরবর্তী আসামের কাছাড় ও করিমগঞ্জ অঞ্চলের প্রায় দেড় কোটি মানুষ তাদের প্রাত্যহিক জীবনে ইহার ব্যবহার করে থাকেন। তবে অনেকেই ভুল করে নাগরী ভাষাকে সিলেটিদের আঞ্চলিক ভাষা ও বাংলা ভাষার উপভাষা বলে মনে করেন, কিন্তু ইহার নিজস্ব লিপিমালা ও ব্যায়াকরণ বিদ্যমান। এই নাগরী ভাষা ব্যবহারকারী বর্তমানে শুধু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর পরিধি বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছে। শুধু গ্রেট ব্রিটেনে সিলেটি ভাষা ব্যবহারকারী সংখ্যা প্রায় পাঁচ লক্ষ। লণ্ডনের সিলেটি রিসার্চ এণ্ড ট্রেন্সলেশন সেন্টারের উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপ দ্বারা বোঝা যায় বিশ্বে প্রায় এক কোটি ষাট লক্ষ মানুষ সিলেটি বা নাগরী ভাষায় কথা বলে।
আধুনিক কালে ভাষাবিদরা ভাষাকে সহজ করার জন্য যে পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করেছেন তাহা ৫০০-৬০০ পূর্বে নাগরী লিপিতে করা হয়েছিল। ইহা এক বিস্ময়কর বিষয়। ভাষাটি এতোটা সহজ যে নারীরা মাত্র আড়াই দিনে শিখতে পারতো। আর পুরুষদের মাত্র একদিন, নারীদের আড়াইদিন লাগার কারণ হলো তারা গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত থাকত, যেমন সিলেটি ভাষাতে -- 'কাজীর ঘরর বাইন্দেও যেলান আড়াই হরফ জানে, অলান নাগরীও হিকা যায় মাত্র আড়াই দিনে'। নাগরী ভাষা এতো কম দিনে মানুষের মুখে আসার জন্য এর জনপ্রিয়তা বাড়ে আকাশচুম্বী।
শুধু কথা বলা এবং জীবনযাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেও সিলেটি ভাষার প্রচলন লক্ষ্য করা যায় প্রাচীন কাল থেকে। এই অঞ্চলের মরমী ও লোককবি, বাউল-ফকির থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের সাহিত্যপ্রেমীরা পর্যন্ত সিলেটি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেছেন। আরও অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ সিলেটি নাগরী ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে। কোরআন শরীফের 'সুরা-নাম' এর সিলেটি ভাষায় তরজমা করা হয়েছে এভাবে ১) তুমি কও আমি আশ্রয় নিলাম মানষর রবর,২) মানষর মালিকর,৩)মানষর মাবুদর,৪) তার ক্ষতি থাকি যে কুমন্ত্রণা দেয় আর লুকাইয়া থাকে,৫) যে কুমন্ত্রণা দেয় মানষর দিলো,৬) জিন্নাতর মাঝ থাকি আর মানষর মাঝ থাকি।
পৃথিবীতে এমন অনেক ভাষা আছে যার কোনো নিজস্ব বর্ণমালা নেই, তবে এই ভাষার লিপি আছে অথচ ভাষা নেই, সারা বিশ্বে এমন ব্যাতিক্রম বোধহয় একমাত্র নাগরী লিপির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আরবি, ফারসি ভাষার সঙ্গে সিলেটি স্থানীয় ভাষার সংমিশ্রণে নাগরী ভাষার উদ্ভব হয়। আধুনিক ভাষার মতো নাগরী ভাষারও একটি নিজস্ব লিপি রয়েছে। ইংরেজিতে যেমন ২৩টি অক্ষর বা বর্ণমালা, বাংলায় যেমন ৫১টি ঠিক তদ্রুপ নাগরী ভাষায় ৩৩ টি বর্ণ রয়েছে। নাগরী ভাষায় স্বরবর্ণ ৫টি এবং ব্যঞ্জন বর্ণ ২৮ টি। এই বর্ণগুলো মধ্যে বাংলা, গুজরাটি, কাইলি,আফগান ও দেবনাগরী লিপির সাদৃশ্য পাওয়া যায়। এই শব্দগুলোতে কম যুক্তাক্ষরে শব্দ গঠন এবং একটি বর্ণ একটি ধ্বনির জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সিলেটি নাগরিতে রচিত অসংখ্য পুঁথি ও গ্রন্থ মূলত ফকিরি তথা বাতেনি বিষয়-আশয় ছাড়াও ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন আখ্যান, কারবালার করুণ কাহিনী, ইউসুফ জুলেখার প্রেম কাহিনী, রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা,চিকিৎসা বিদ্যা,ও জাদুবিদ্যা সম্পর্কীত তথ্য সহ বিভিন্ন 'রাগ' অর্থাৎ গানও স্থান পেয়েছে। গানগুলো সৃষ্টিতত্ত্ব, আধ্যাত্মতত্ত্ব,দেহতত্ব ও ফকিরি বিষয়ে রচিত। নাগরী লিপিতে প্রণীত কালজয়ী গ্রন্থ হালাতুন্নবী,জঙ্গনামা,গগালিব হুসেইন, সোনাভানের পুঁথি, অন্যতম জায়গা দখল করে আছে সিলেটিদের মনে। তাছাড়া মহরম মাসে জঙ্গনামা গ্রন্থ থেকে মহরমের জারি হিসেবে সুর করে গানে নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই পাঠে অংশ নেয়। এছাড়া আধুনিক সময়ের অসংখ্য জনপ্রিয় গান রয়েছে যাহা নাগরী লিপিতে লিখা হয়েছিল। যেমন-- সৈয়দ সাহনুরের 'অরিন জংগোলর মাঝে বানাইলাম ঘর' কিংবা শিতলাংশাহের 'অজ্ঞান মন' সহ এমন উদাহরণ রয়েছে।
নাগরী লিপিতে লিখিত পুঁথি,গান বর্তমানে অবলুউপথ ধরেছে। যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা এবং সংরক্ষণের অভাবে নব প্রজন্মের কাছে এর ভাণ্ডারটি অনেকটাই অজানা থেকে যাচ্ছে। আধুনিকতাকে হাতের নাগালে আনতে নিজ অস্তিত্ব বিলীন হচ্ছে। আর প্রশ্রয় দিচ্ছি পাশ্চাত্যের রকমারি গান-বাজনা ও দৃশ্য শ্রাব্যের উপর। ফলে নাগরী পুঁথি পাঠের আকর্ষণ ও হারিয়ে ফেলছি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই বহু ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী বিচিত্রমুখী এসব পুঁথি চিরতরে নিভে যাচ্ছে।
গবেষকদের মতে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সিলেটি নাগরী ভাষাকে স্বীকৃতি না দিলে এবং এর প্রচোলন না ঘটালে এক সময় প্রাচীন এই ভাষাটি হারিয়ে যাবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষার তালিকা থেকে বাদ পড়বে। আশার কথা ইদানিং নাগরী লিপিতে লিখিত বইয়ের পুনঃমুদ্রণের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। তবে বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ রাখার স্বার্থে সিলেটি নাগরী লিপিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
____________________________________________________________________
জা হি দ রু দ্র
বিলুপ্তির পথে নাগরী ভাষা
ভাষা হচ্ছে একটি জাতির নির্ণায়ক উপাদান। পৃথিবীতে প্রথম মানুষের বিকাশ হয়েছে ভাষাহীন যুথবুদ্ধি প্রাণী হিসেবে। তারপর ক্রমশ শ্রম প্রচেষ্টায় হাত এবং সবশেষে আঙ্গুলের সূক্ষ্ম ব্যবহারের মাধ্য দিয়ে মস্তিষ্কের সেরিব্র্যাল কর্টেক্সের বিকাশের ফলে,সুবিধা ও সহযোগিতা মূলক জীবন নিশ্চিতির চেষ্টায় অর্থ,ভাব ও উদ্দেশ্য বিনিময়ের লক্ষ্যে বস্তু, বিষয়,ও ঘটনার শাব্দিক প্রকাশের উদ্ভব তাঁদের ব্যবহারের নিয়ম বিকশিত হয়েছে। আজ থেকে প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগে মানুষের পূর্বপুরুষ প্রাণীটি শিম্পাঞ্জিদের পূর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে এই প্রাণীগুলোর ভাষা ছিল তুলনামূলক ভাবে বেশ উন্নত।কিন্তু মানুষদের এই আদি পূর্বপুরুষদের ভাষার প্রকৃতি সম্পর্কে খুব কমই জানতে পারা গেছে। পৃথিবীর সকল মানুষ অখণ্ড মানবতার অংশ হলেও ভিন্ন ভিন্ন যে সমস্ত ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক উদ্দীপনার প্রতি সাড়া দিয়ে প্রতিক্রিয়া ও অভিযোজনের মধ্য দিয়ে তারা ভিন্ন ভিন্ন নৃগোষ্ঠী ও জনজাতিতে বিকশিত হয়েছে। তার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে তাদের ভিন্ন ভিন্ন ভাষা।
সিলেটের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নিজস্ব স্বকীয়তার এক বড় উদাহরণ হল 'নাগরী ভাষা'। বর্তমানে ভাষাটি নতুন প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্পের আকার নিয়েছে এবং ইহার ব্যবহার অস্তাচলে গিয়েছে। তবে এটি এমন এক ব্যাতিক্রমী ভাষা যাহার লিপি আছে কিন্তু ভাষাটি হারিয়ে গিয়েছে। নিজস্ব ভাষার অধিকারী, সিলেটি নাগরী ভাষা বাংলা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং প্রাচীন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষা এই তথ্য প্রায় সিলেটিদের অজানা। তাই সিলেটি ভাষা আজ উপেক্ষিত। সিলেটিদের নিজস্ব লিপি নাগরী আজ লুপ্ত প্রায়।
পৃথিবীতে প্রায় আট হাজার ভাষা আছে। এরমধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষার সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। এই তিন হাজার ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা আছে এবং যা মানুষের মুখে উচ্চারিত রয়েছে। বিশ্বের স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষার মধ্যে সিলেটি 'নাগরি' ও একটি। গবেষকদের মতে এই ভাষার সীমাবদ্ধতা শুধু বাংলাদেশে নয় বরং ইহা ভারতের অসম রাজ্যের কাছাড়, করিমগঞ্জ,হাইলাকান্দি,ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের বহু সংখ্যক লোকের মাতৃভাষা সিলেটি। তাই বাঙালি হিসেবে যদিও মাতৃভাষা বাংলা কিন্তু সিলেটিদের ছিল প্রাচীন নাগরী। ফ্রান্সের বিখ্যাত ভাষা যাদুঘরে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার উদৃতি রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ দুটি ভাষার বিষয়ে উল্লেখ আছে। এর একটি বাংলা আরেকটি নাগরী। নাগরী ভাষা নিয়ে দেশে বিদেশে চলছে গবেষণা। কিন্তু প্রাচীন এই ভাষাটির এখনও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। এই ভাষার উপর গবেষণা, পি,এইচ,ডি নেওয়া হচ্ছে বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ব্রিটেনে সিলেটি ভাষা শিক্ষার কয়েকটি ইনস্টিটিউট থাকলেও আমাদের অঞ্চলে সিলেটি ভাষা শিখার কোনো ক্ষেত্র নেই। ইহা খুবই পরিতাপের বিষয়। যার ফলে সিলেটি ভাষা মানুষের মুখে থাকলেও এর বর্ণমালা অনেকটা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হারিয়ে যাচ্ছে এর ইতিহাসও।
এই নাগরী চর্চা ও গবেষণা হলে অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সন্ধান পাওয়া যাবে। এই ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস থেকে জানা যায় জটিল সংস্কৃতি প্রধান বাংলা বর্ণমালার বিকল্প লিপি হিসেবে সিলেটি নাগরী লিপির উদ্ভাবন হয়েছিল খ্রিষ্ট্রীয় চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। গবেষকদের ধারণা ইসলাম প্রচারক সুফি সাধক হজরত শাহজালাল (রঃ) সঙ্গে ৩৬০ আউলিয়া সিলেটে আসেন বিভিন্ন দেশ ও এই উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চল থেকে। তাদের প্রচলিত ভাষা বাংলা ছিল না, তাই এই অঞ্চলের মানুষের সাথে ভাব বিনিময়ের জন্য একটি ভাষা চর্চার শুরু হয় এবং পরবর্তীতে ইহা নাগরী ভাষা নামে পরিচিতি লাভ করে।
বৃহত্তর সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদী তীরবর্তী হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার এবং সুনামগঞ্জ এই চারটি জেলার মানুষ ছাড়া ভারতের বরাক নদী তীরবর্তী আসামের কাছাড় ও করিমগঞ্জ অঞ্চলের প্রায় দেড় কোটি মানুষ তাদের প্রাত্যহিক জীবনে ইহার ব্যবহার করে থাকেন। তবে অনেকেই ভুল করে নাগরী ভাষাকে সিলেটিদের আঞ্চলিক ভাষা ও বাংলা ভাষার উপভাষা বলে মনে করেন, কিন্তু ইহার নিজস্ব লিপিমালা ও ব্যায়াকরণ বিদ্যমান। এই নাগরী ভাষা ব্যবহারকারী বর্তমানে শুধু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর পরিধি বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছে। শুধু গ্রেট ব্রিটেনে সিলেটি ভাষা ব্যবহারকারী সংখ্যা প্রায় পাঁচ লক্ষ। লণ্ডনের সিলেটি রিসার্চ এণ্ড ট্রেন্সলেশন সেন্টারের উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপ দ্বারা বোঝা যায় বিশ্বে প্রায় এক কোটি ষাট লক্ষ মানুষ সিলেটি বা নাগরী ভাষায় কথা বলে।
আধুনিক কালে ভাষাবিদরা ভাষাকে সহজ করার জন্য যে পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করেছেন তাহা ৫০০-৬০০ পূর্বে নাগরী লিপিতে করা হয়েছিল। ইহা এক বিস্ময়কর বিষয়। ভাষাটি এতোটা সহজ যে নারীরা মাত্র আড়াই দিনে শিখতে পারতো। আর পুরুষদের মাত্র একদিন, নারীদের আড়াইদিন লাগার কারণ হলো তারা গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত থাকত, যেমন সিলেটি ভাষাতে -- 'কাজীর ঘরর বাইন্দেও যেলান আড়াই হরফ জানে, অলান নাগরীও হিকা যায় মাত্র আড়াই দিনে'। নাগরী ভাষা এতো কম দিনে মানুষের মুখে আসার জন্য এর জনপ্রিয়তা বাড়ে আকাশচুম্বী।
শুধু কথা বলা এবং জীবনযাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেও সিলেটি ভাষার প্রচলন লক্ষ্য করা যায় প্রাচীন কাল থেকে। এই অঞ্চলের মরমী ও লোককবি, বাউল-ফকির থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের সাহিত্যপ্রেমীরা পর্যন্ত সিলেটি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেছেন। আরও অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ সিলেটি নাগরী ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে। কোরআন শরীফের 'সুরা-নাম' এর সিলেটি ভাষায় তরজমা করা হয়েছে এভাবে ১) তুমি কও আমি আশ্রয় নিলাম মানষর রবর,২) মানষর মালিকর,৩)মানষর মাবুদর,৪) তার ক্ষতি থাকি যে কুমন্ত্রণা দেয় আর লুকাইয়া থাকে,৫) যে কুমন্ত্রণা দেয় মানষর দিলো,৬) জিন্নাতর মাঝ থাকি আর মানষর মাঝ থাকি।
পৃথিবীতে এমন অনেক ভাষা আছে যার কোনো নিজস্ব বর্ণমালা নেই, তবে এই ভাষার লিপি আছে অথচ ভাষা নেই, সারা বিশ্বে এমন ব্যাতিক্রম বোধহয় একমাত্র নাগরী লিপির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আরবি, ফারসি ভাষার সঙ্গে সিলেটি স্থানীয় ভাষার সংমিশ্রণে নাগরী ভাষার উদ্ভব হয়। আধুনিক ভাষার মতো নাগরী ভাষারও একটি নিজস্ব লিপি রয়েছে। ইংরেজিতে যেমন ২৩টি অক্ষর বা বর্ণমালা, বাংলায় যেমন ৫১টি ঠিক তদ্রুপ নাগরী ভাষায় ৩৩ টি বর্ণ রয়েছে। নাগরী ভাষায় স্বরবর্ণ ৫টি এবং ব্যঞ্জন বর্ণ ২৮ টি। এই বর্ণগুলো মধ্যে বাংলা, গুজরাটি, কাইলি,আফগান ও দেবনাগরী লিপির সাদৃশ্য পাওয়া যায়। এই শব্দগুলোতে কম যুক্তাক্ষরে শব্দ গঠন এবং একটি বর্ণ একটি ধ্বনির জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সিলেটি নাগরিতে রচিত অসংখ্য পুঁথি ও গ্রন্থ মূলত ফকিরি তথা বাতেনি বিষয়-আশয় ছাড়াও ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন আখ্যান, কারবালার করুণ কাহিনী, ইউসুফ জুলেখার প্রেম কাহিনী, রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা,চিকিৎসা বিদ্যা,ও জাদুবিদ্যা সম্পর্কীত তথ্য সহ বিভিন্ন 'রাগ' অর্থাৎ গানও স্থান পেয়েছে। গানগুলো সৃষ্টিতত্ত্ব, আধ্যাত্মতত্ত্ব,দেহতত্ব ও ফকিরি বিষয়ে রচিত। নাগরী লিপিতে প্রণীত কালজয়ী গ্রন্থ হালাতুন্নবী,জঙ্গনামা,গগালিব হুসেইন, সোনাভানের পুঁথি, অন্যতম জায়গা দখল করে আছে সিলেটিদের মনে। তাছাড়া মহরম মাসে জঙ্গনামা গ্রন্থ থেকে মহরমের জারি হিসেবে সুর করে গানে নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই পাঠে অংশ নেয়। এছাড়া আধুনিক সময়ের অসংখ্য জনপ্রিয় গান রয়েছে যাহা নাগরী লিপিতে লিখা হয়েছিল। যেমন-- সৈয়দ সাহনুরের 'অরিন জংগোলর মাঝে বানাইলাম ঘর' কিংবা শিতলাংশাহের 'অজ্ঞান মন' সহ এমন উদাহরণ রয়েছে।
নাগরী লিপিতে লিখিত পুঁথি,গান বর্তমানে অবলুউপথ ধরেছে। যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা এবং সংরক্ষণের অভাবে নব প্রজন্মের কাছে এর ভাণ্ডারটি অনেকটাই অজানা থেকে যাচ্ছে। আধুনিকতাকে হাতের নাগালে আনতে নিজ অস্তিত্ব বিলীন হচ্ছে। আর প্রশ্রয় দিচ্ছি পাশ্চাত্যের রকমারি গান-বাজনা ও দৃশ্য শ্রাব্যের উপর। ফলে নাগরী পুঁথি পাঠের আকর্ষণ ও হারিয়ে ফেলছি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই বহু ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী বিচিত্রমুখী এসব পুঁথি চিরতরে নিভে যাচ্ছে।
গবেষকদের মতে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সিলেটি নাগরী ভাষাকে স্বীকৃতি না দিলে এবং এর প্রচোলন না ঘটালে এক সময় প্রাচীন এই ভাষাটি হারিয়ে যাবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষার তালিকা থেকে বাদ পড়বে। আশার কথা ইদানিং নাগরী লিপিতে লিখিত বইয়ের পুনঃমুদ্রণের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। তবে বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ রাখার স্বার্থে সিলেটি নাগরী লিপিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
____________________________________________________________________
No comments:
Post a Comment