Saturday 29 June 2019

Shishir Bindu Nath

প্রবন্ধ


           












                          শি    শি   র    বি    ন্দু    না   থ             

                            একটি  অনৈতিহাসিক  রচনা                      
                    আজকের দিনে শ্রীকৃষ্ণ কতটা প্রাসঙ্গিক ?





গোড়াতেই এটা বলে নেওয়া ভাল যে, আমার মতে শ্রীকৃষ্ণ একজন নন, এমনকি দু'জন ও নন।
শ্রীকৃষ্ণ আসলে তিনজন।
আর এই তিনজন শ্রীকৃষ্ণই, বিভিন্ন সময়কালের বিভিন্ন শিক্ষিত সব মানুষের দ্বারা সৃষ্টি।

প্রথম শ্রীকৃষ্ণ, "বিষ্ণুর অষ্টম অবতার"।  এই শ্রীকৃষ্ণ, যিনি সেই সময়কার সমাজের সর্বোত্তম নেতা ও সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি, আসলে সামাজিক প্রতীকী।
আর সময়টা হ'ল, নিঃসন্দেহে বৈদিক যুগ।

তাঁর আগের অবতার ছিলেন শ্রীরাম। তিনি ছিলেন বিষ্ণুর সপ্তম অবতার।
সময়টা কি ছিল?
যে সময়ে, মানুষের  সমাজে কৃষি তথা 'চাষবাস' শুরু করলো এবং প্রতিষ্ঠিত ও হ'ল। 
চাষ এবং বাস। 
কৃৃষিকে কেন্দ্র করে বসতি তৈরী হ'ল।
সমাজ তৈরী হ'ল। সামাজিক 'ধর্ম' ও তৈরী হ'ল।
তখন ধর্ম বলতে বোঝানো হ'ত সত্য এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা।
তখন কিন্তু ধর্ম বলতে হিন্দু ধর্ম বোঝাতো না।

তার আগের ও অর্থাৎ ষষ্ঠ অবতার ছিলেন পরশুরাম, যিনি 'প্রথম শিক্ষিত মানব' সমাজের প্রতিনিধি।
অস্ত্র বিদ্যায় শিক্ষিত।
হাতে প্রতীকী কুঠার।
বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হতে শুরু করলো।
এই অবতার আসলে কিন্ত মানুষের সমাজের বিবর্তনের এক একটা ধাপ এবং প্রতীকী রূপ।
যেমন ধরুন.....
মৎস, প্রথম অবতার, প্রথম প্রাণের সঞ্চার এবং সেটা জলে।
কূর্ম, দ্বিতীয় অবতার,  প্রাণী জল থেকে ডাঙ্গায় উঠে এলো এবং উভচর।
কূর্ম মানে কচ্ছপ।
( কারো কারো মতে এবং যাঁরা লোকায়ত দর্শনে বিশ্বাস করেন, তাঁদের কাছে কচ্ছপ এবং কাশ্যপে বিশেষ ফারাক নেই।)

তৃতীয় অবতার বরাহ, ডাঙ্গার প্রথম প্রাণী।
চতুর্থ নৃসিংহ অর্থাৎ নরসিংহ, অর্থাৎ আধা পশু, আধা মানুষ।
বিবর্তন চলছে।
পঞ্চম বামন, প্রথম নানুষ। পিগমী।
এঁরাই আদি মানব।

শ্রীকৃষ্ণ মানে তখন মানুষের বিবর্তন অনেক এগিয়ে গেছে।
পাশ্চাত্য সভ্যতা বিবর্তনের যে বিবরন মাত্র তিনশ বছর আগে দিয়েছেন,  সে বৈজ্ঞানিক ভাবনা আমাদের দেশের বৈদিক মুনি ঋষিরা তিন হাজার বছর আগেই পৌরাণিক কাহিনীর মাধ্যমে বলে গেছেন।
এই হ'লেন প্রথম শ্রীকৃষ্ণ, অবতার শ্রীকৃষ্ণ।

তারপরের শ্রীকৃষ্ণ, অর্থাৎ  দ্বিতীয় শ্রীকৃষ্ণ,  দ্বারকার রাজা। ঐতিহাসিক কিনা জানিনা, তবে নিশ্চিত করে সাহিত্যের নায়ক।
চাণক্য তথা কৌটিল্যের প্রভাব পরিষ্কার!
বাস্তবের ঐতিহাসিক কৌটিল্যই কি সাহিত্যের শ্রীকৃষ্ণ?
এই শ্রীকৃষ্ণ উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন, কিন্তু মাটির এবং মানুষের কাছাকাছি।
ব্যাসদেব যে শ্রীকৃষ্ণের কথা বলেছেন, তিনি দ্বারকার রাজা, যদুবংশীয় শ্রীকৃষ্ণ যিনি হলেন আসল শ্রীকৃষ্ণ!
অত্যন্ত ক্ষমতাশালী, বুদ্ধিমান, কূটবুদ্ধিতে অদ্বিতীয়, শ্রেষ্ঠ নেতা।

তৃতীয় শ্রীকৃষ্ণ হলেন গীতার শ্রীকৃষ্ণ। 
সবচেয়ে রঙীন। প্রথম আর দ্বিতীয় শ্রীকৃষ্ণের সমন্বয়ে ত বটেই, ইতিমধ্যে মানুষ সমাজে যাবতীয় জ্ঞানের সঞ্চিত ভান্ডার এই তৃতীয় শ্রীকষ্ণের মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে।
তারসঙ্গে অত্যন্ত সচেতনভাবে তাঁকে পরমেশ্বর বানাবার চেষ্টা।

এইখান থেকেই শুরু হ'ল বিবর্তনের আরেক দিক।
মানব সভ্যতা যত এগোতে চায়, কিছু স্বার্থান্বেষী সুবিধাভোগীরা চায়,  পুরনো ব্যবস্হাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে।
আজো ও তার ব্যতিক্রম হয়না।

বৈদিক ধর্ম এবং বৈদিক সমাজ যখন ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছিল সময়ের সাথে সাথে, উঠে এলো নতুন ভাবনা। নতুন চিন্তাধারা।
বৌদ্ধধর্মের হাত থেকে হিন্দুধর্মকে বাঁচাতে, তৎকালীন হিন্দু ইন্টেলেকচুয়ালরা দ্বারকার শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর বানিয়ে দিয়েছেন! না করে উপায় ছিল না!
তার কারন বৌদ্ধধর্ম তখন হু হু করে এগোচ্ছে।

এটা কখনো ভেবে দেখেছেন, কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যে বাণী দিয়েছিলেন, সেটা কে বা কারা, সামনে দাঁড়িয়ে শুনেছেন?
গীতার রচয়িতা বা রচয়িতার দল?  নাকি লেখক ছিলেন স্বয়ং কৃষ্ণ?  
নাকি অর্জুন?
কাগজে কলমে যখন লেখা হয়েছে, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে অন্য কেউ বা কারা এটা লিখেছেন!
তাঁরা কারা?

বোঝা গেল কী, গীতার  প্রকৃত লেখক কে বা কারা?
বৌদ্ধধর্মকে আটকাতে চেয়েছিলেন যে সব হিন্দু ইন্টেলেকচুয়াল, তাঁরা!

এটাও নিশ্চয় জানেন, ব্যাসদেব যে আদি কাব্যটি লিখেছিলেন, তার নাম ছিল "জয়", মহাভারত নয়। তাতে ছিল চার হাজার শ্লোক। অর্থাৎ আট হাজার লাইন।

ঋষি বৈশম্পায়ন তথা ব্যাসদেবের শিষ্য, তিনি জয়কাব্যের প্রচার করতে করতে তাকে বাড়িয়ে করলেন আট হাজার শ্লোক। জয়কাব্যের নাম দিলেন " ভারত"।
এই দুই কাব্যের কোনোটাতেই গীতা বলে কিছু ছিল না। শ্রীকৃষ্ণ অবশ্যই ছিলেন। দ্বারকার রাজা শ্রীকৃষ্ণ। কৌরবরা ছিল, পান্ডবরা ও ছিল অবশ্যই। তবে, গীতা নয়!

'ভারত' যখন "মহাভারত" হ'ল, আট হাজার শ্লোক বেড়ে হয়ে গেল এক লক্ষ শ্লোক, যে মহাভারতটা  এখনআমরা দেখি, জানি, পড়ি।

ঐ অনৈতিহাসিক সময়ে, যাকে আরামসে পৌরাণিক যুগ বলা যায়, ৭৬ শ্লোকের "অর্জুন বিষাদ কাব্য", ৭০০ শ্লোকের " গীতা"  হয়ে, মহভারতে ঢুকে গেল! আসলে ঢোকানো হ'ল।
কে বা কারা ঢোকালো, কবে ঢোকালো, সেটা কেউ জানেনা, সেটা অনৈতিহাসিক।
তবে কেন ঢোকালো সেত পরিষ্কার বোঝা যায়!
বৌদ্ধ ধর্মকে আটকাও!

উপনিষদ এবং ভাগবদ গীতার মূল উদ্দেশ্য ছিল পচে যাওয়া ব্রাহ্মণ্যবাদকে বাদ দেওয়া, যা নাকি শেষের দিকে যজ্ঞ আর বর্ণ-বৈষম্য সার-এ পরিণত হয়েছিল -  এবং ব্রাহ্মণদের জীবিকা সর্বস্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
জ্ঞানযোগ এর ওপর জোর দেওয়া হল যাগ-যজ্ঞকে রিফর্ম করার জন্য, যাতে ব্রাহ্মণরাই নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে।
আর কর্মযোগটা ডিজাইন করলো ক্ষত্রিয়দের পচা আচারকে রিফর্ম করার জন্য। অর্জুনকে কৃষ্ণের পায়ের কাছে বসিয়ে, মন্ত্রমুগ্ধ করে শোনানো হল, ব্রাহ্মণ ইন্টেলেকচুয়ালরা যা বলতে চেয়েছিল।

ভাগবদ গীতার মূল লক্ষ্যই ছিল নির্বোধ, অর্থহীন যজ্ঞাদি পরিহার করে, বর্ণধর্মের ওপর বেশী জোর না দিয়ে, ভক্তিরসের মাধ্যমে এক ভগবানকে পূজা করা। 
হয়নি সেটা।
তবে, এখন যেমন অনেক দল আছে, মার্ক্সবাদী দলই কতগুলো, দেখুন - তখনো তাই ছিল। যে যার মত মার্ক্সবাদ লিখেছে - বুঝে না বুঝে - তেমনি গীতাও অনেকের মত ভাব আর মত ঢুকেছে, কলেবর বৃদ্ধির সময়।
এটা ভাবার কারন নেই যে  বৈদিক ধামাধারী স্বার্থান্বেষী, ক্ষমতালোভী ব্রাহ্মণরাই শুধু এটা করেছে। এক্কেবারেই না।
তারা ত চেষ্টা করে গেছে, যা চলছিল, সেটাই বজায় রাখার জন্য। যাকে বলে কায়েমী স্বার্থ রক্ষা করা।
আরো গোষ্ঠী ও জল দিয়েছে অনেক!
ভাবুন, একবার বলছে, কর্মই সব, আবার বলছে আমাকে স্মরণ নাও।
ভাবুন শ্রীকৃষ্ণ নাকি পরমেশ্বর! তিনি বলছেন, যুদ্ধ কর। খুন কর।

প্রথমে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব, তার পর প্রায় ৭০০ বছরের মুসলমান শাসনের অত্যাচার,  গীতার 'ঐতিহাসিক ভূমিকা'-টাই খর্ব হয়ে গেল।
ইতিহাসটাই গায়েব হয়ে গেল, করে ও দেওয়া হ'ল।

পরবর্তীকালে আচার্য্য আর স্বামীজীরা এসে অর্জুন আর শ্রীকৃষ্ণকে আবার সেই কুরুক্ষেত্রেই নিয়ে গিয়ে ফেল্ল, যার ভিত্তিটাই ছিল অন্য।

উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং কল্পনার মুন্সীয়ানায় মানুষ কৃষ্ণকে ভগবান সাজিয়ে, সেই যে হা করিয়ে বিশ্বরূপ দর্শন করিয়ে দিল, আজো সেই হা মুখ আর বন্ধ হল না। শ্রীকৃষ্ণ ভগবানই থেকে গেল। আর যে যা পারলো শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে খেলে গেল।
এখনো খেলছে!

ব্রাহ্মণ আর সাধুরা যতনা খেলছে, তার চেয়ে বেশী খেলছে রাজনৈতিক নেতারা।

মানুষের বিশ্বাস পরিণত হল ভয়ে, ন্যায়-অন্যায় আর পাপ-পুণ্য পরিণত হল পূর্ব জন্ম পরজন্মের সুকৃতি আর কুকৃতিতে!
আজ পর্যন্ত কোন শিক্ষিত মানুষ এটা ভাবলই না ৮৯ কোটি যোনির হিসেব কোন্ সুপার কম্পুটারে ধরা আছে আর সেই রেকর্ড কোথায় পেলেন ঐ পন্ডিতেরা?
শ্রীকৃষ্ণই যে ভগবান এটা মানুষের কোন্ বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয়?

শ্রীকৃষ্ণ যে ইহুদী, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, মুসলমান, আফ্রিকা তথা পৃথিবীর কোন আদিবাসীর কাছেই ভগবান নয় - যার সংখ্যাটাই ব্যাপক, সেই সত্য শিক্ষিতেরা বুঝে গেলেও, মন্দির ব্যবসায়ীরা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা লোভীরা এই সত্যকে বাঁচতে দেবেনা।
মানুষ যেদিন মন্দির থেকে শিব-কালী-কৃষ্ণকে বের করতে পারবে, সেদিন  ছয় লক্ষ মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত ২৫-৩০ কোটি মানুষের অন্ন সংস্হান বন্ধ হয়ে যাবে। এটাও একটা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রশ্ন যার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত আছে কুচক্রী রাজনৈতিক নেতাদের মরন বাঁচনের ব্যাপারটা।
এটাই ভারতবর্ষের ভবিতব্য।
হতাশা নয়, চূড়ান্ত বাস্তব।

সুতরাং শ্রীকৃষ্ণ আর কোনো দিনই মানুষ হবেন না, ভগবানই থেকে যাবেন। অন্য ধর্মে, ভগবানের প্রতিনিধি হয়ে  বাণী দেওয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে, এখানে শ্রীকৃষ্ণকেই ভগবান বানিয়ে দেওয়া হয়েছে!
হায় ভগবান!
তুমি আবার গাছের ডালে বসে, ব্যাধের হাতে তীর খেয়ে মরলে?
(আর ভগবান শ্রীরাম মরলেন সরযূর জলে ডুবে! মানুষকে ভগবান বানালে এমনটাই হয়!
পরশুরামের ক্ষেত্রে তেমন হয়নি।
তিনি তাই অমর!)

শ্রীকৃষ্ণের যুক্তিগ্রাহ্য ইতিহাস পুরো গুবলেট হয়ে আছে। পৌরাণিক গল্পের ফাঁদে আপনাকে এমন বেঁধে রেখেছে যে তিন শ্রীকৃষ্ণের হা করা মুখ আর বন্ধ হতে দেবেনা।

আপনার আমার বস্তুবাদ, ভক্তিবাদ, সত্য মিথ্যার বিতর্ক বড়? নাকি ২৫-৩০ কোটি মানুষের অন্ন সংস্হান বড়? 
সে প্রশ্ন ও জড়িয়ে আছে মন্দির শিল্পে।

ছয় লক্ষ+  মন্দিরের সমন্বয়ে সৃষ্ট "মন্দির শিল্প" মানেই অত কোটি মানুষের অর্থনৈতিক কর্মসংস্হান এবং তার সঙ্গে যুক্ত ব্যবসা বাণিজ্য।
কে সামাল দেবে?

শ্রীকৃষ্ণ  ভগবান না মানুষ সেটা আগে ঠিক করা দরকার। অর্জুন বিষাদ কাব্য যে গীতারই অগ্রজ, এটাও বিশ্বাস করা দরকার।
বিশ্বাস করা দরকার যে 
দুটো কাব্যের রচয়িতারাই, বাস্তবের অশোককে বানিয়েছেন গীতার অর্জুন।
গীতার অর্জুন আর মহাভারতের অর্জুন মোটেই এক ব্যক্তি নয়!
বরং  মিলিয়ে নিন....
অশোকের ও ৯৯টা ভাই ছিল, অর্জুনের ও তাই। দু ক্ষেত্রেই কেউ আপন ভাই ছিল না। 

দু'জনেই ১২/১৩ বছর বনবাস এ বা রাজধানী থেকে দূরে ছিল। গবেষণা চলছে। 

ঐতিহাসিক আর অনৈতিহাসিক এই মানদন্ডটাই ঠিক হয়নি ভারতবর্ষে।
ভক্তিভাব আর পাপ পুণ্য একাকার করে দেওয়া হয়েছে।
পূর্বজন্ম আর পরজন্মের শৃঙ্খল পায়ে নয়, মনে পরানো আছে।
দশম অবতার, কল্কি অবতার কি পারবে  অষ্টম অবতার শ্রীকৃষ্ণের তাঁর যথাযথ রূপটা দেখাতে?
তার কারন, নবম অবতার বুদ্ধদেব সেটা
কিন্তু পারেননি।
আশা করি, আগামী দিনই সেটা ঠিক করে দেবে।।

No comments:

Post a Comment