Saturday, 29 June 2019

Albert Ashok

প্রবন্ধ
        অ্যা         বা     র্ট             শো     

( অ্যালবার্ট অশোক শিল্পসাহিত্যের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। বাংলার থেকে অনেক দুরে - বিশ্বের নানা দেশের শিল্প সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক খবর/ সমসাময়িক ও অতীতের ঘটনায়  তিনি চোখ রাখেন। এবং সেইগুলির গবেষণা মূলক ও বিশ্লেষন তিনি ধারাবাহিক লিখবেন। )

                                 
                                      
 গুণগত  মান  বনাম  প্রচারঃ  ‘মোনা লিসা’




 লিওনার্দো দা ভিঞ্চির লুভ্যর মিউজিয়ামের ‘মোনা লিসা’ Louvre Mona Lisa  painting
পৃথিবীর দৃশ্যকলা জগতে, ‘মোনা লিসা’ একটি বিখ্যাত ছবি। ফ্রান্সের লুভ্যর মিউজিয়ামে গেলে আর কিছু দেখুক না দেখুক, ভ্রমণার্থিরা মোনা লিসা’ ছবি খানি দেখবেনই। এটি বিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এঁকেছিলেন ১৫০৩ থেকে ১৫১৭ সালের মধ্যে। সারা পৃথিবীর আশ্চর্যতম ছবি, জনপ্রিয় ছবি, লাখো মানুষের অনুপ্রেরণার ছবি। শুধু শিল্পীরাই নন, সাধারণ মানুষ, দেশ, জাতি, শ্রেণী কাল ভুলে মোনালিসা শব্দটি শুনেননি এরকম বোধ হয় সভ্যজগতে কেউ নেই।

মানুষ তথ্য যতটুকু মোনালিসা সম্পর্কে না জানে, গল্প করে এর চেয়ে বেশী, মনগড়া গল্প করে বোদ্ধার ভান করে। এসবের মধ্যেই, যারা ছবি ভাস্কর্যের ছাত্র, শিল্পী, তাদের অনেক প্রশ্ন ও কৌতূহলের উত্তর তারা পাননা। উত্তর না পেলে লোকে গল্প বানিয়ে, গুজব বানিয়ে শূন্যস্থান পূর্ণ করে। এতে সত্যের অপলাপ ও ক্ষতি হয়।
শিল্প সাহিত্যের দুটি দিক আছে। একটা ব্যবসায়িক রোজগারের দিক। আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে শিল্প সাহিত্য চলার পথকে মসৃণ করে, এবং তা ফরমায়েশি কাজের মাধ্যমে। এই কাজ যারা করেন তারা পেশাগত ভাবে চাকরি ও ব্যবসায়ের মাধ্যমে রোজগার করেন। আরেকটা দিক হল সৃষ্টি। শিল্প সাহিত্য সৃষ্টি। এখানে পয়সা উপায়ের কথা প্রাথমিক স্তরে একদমই থাকেনা। মানুষের জীবন যাপনে হঠাৎ কিছু আবিষ্কার হল; হতে পারে একটা ছোট্ট ভাবনা।এই ভাবনাকে  সাধারণ মানুষের নজরে আনার জন্য সুন্দর এক মোড়ক বা মাধ্যমে বস্তু বা ভাবনাকে গ্রহনীয় করে তুলে উপস্থাপনা করা হয়। সাধারনত, এই সৃজনকাজের আর্থিক মূল্য  শূন্য থাকে যতদিন না কোন সংগ্রাহক ভালবেসে সেই সৃষ্ট শিল্প দ্রব্যটি অর্থমূল্য দিয়ে কিনে নিচ্ছেন। বৃহত্তর জাতির কাজে লাগছে।

ঊনিশ শতকের আগে,  সভ্যতা শুরুর দিক অবধি, লোকসংস্কৃতি থেকে মূল সংস্কৃতি, লোক শিল্প থেকে  মূল শিল্প; সৃষ্টি করে শিল্পীরা  বিক্রী করতে পারতেননা। দু একজনের কথা আলাদা। ফলে অধিকাংশ শিল্প ফরমায়েশী বা কমিশনিং এর মাধ্যমে করা হত। পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রাজা জমিদার, মঠ গীর্জার কর্তৃপক্ষ ও শিল্পপতিরা। যেমন সিস্টিন চ্যাপেল এ মাইকেলএঞ্জেলো বাইবেল থেকে বিষয় নিয়ে অনেক পেইন্টিং করেছিলেন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মোনা লিসা ইত্যাদি। এই কমিশন বা ফরমায়েশি কাজ ই বিশ্বের অধিকাংশ শিল্প ভাস্কর্য সুন্দরের ইতিহাস গড়েছে। ভ্যানগঘ মৃত্যুর আগে সারাজীবনের নিরিখে একটি মাত্র ছবি বিক্রী করতে পেরেছিলেন। তূলনামূলক পল গঁগ্যা অনেক ছবি বিক্রী করেছিলেন। তারা ফরমায়েশী ছবি করেননি। তবে বুদ্ধিদীপ্ত কিছুও করেননি। মূলতঃ চিত্তবিনোদন ও সুন্দর সৃষ্টিই ছিল মূল বিন্দু। সেই সময়টা ঊনবিংশর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর পত্তনের দিক।

 শিল্পের ইতিহাস দেখলে দেখা যায় বহু সৃষ্টি ফরমায়েশী বা নিজের তাগিদ থেকে করা, ধনী ব্যবসায়ী বা মিউজিয়ামে সংগ্রহিত আছে, তা বর্তমানে তাদের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। উৎসাহী বা আগ্রহী শিল্প রসিকরা দেখে মনে রাখেননা। এই নিরিখে মোনা লিসা ছবিটি  একবিংশ শতাব্দীতে  বিশাল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। কেন? কি আছে ছবিটিতে? এটা কী শিল্পজ্ঞানহীন মানুষের নির্বুদ্ধিতা না তার একটি  শৈল্পিক গুণগত মান আছে। না দুটিই কমবেশী আছে। তো আমি এরকম জিরো পয়েন্ট থেকে ছবিটির চুলচেরা বিচার ও বড় বড় পন্ডিত মানুষের কথা সাধারণ মানুষকে জানানোর জন্য এই প্রবন্ধের অবতারণা করেছি।

অনেকেই জানেননা। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, (15 April 1452 – 2 May 1519) বিশ্ব বিখ্যাত, ও প্রকান্ড জনপ্রিয় হলেও তার পেইন্টিং কিন্তু গোনা, মাত্র ২০টি। তার মধ্যে  ১৫টির অস্তিত্ব আছে। সারা পৃথিবীতে এমন নজির নেই যে, মাত্র ২০ টি পেইন্টিং করেছেন কোন শিল্পী! শিল্পী মানেই কম করেও ৫০০ /  বা হাজার সংখ্যক পেইন্টিং করে থাকবেন। স্বাভাবিক ভাবেই যারা শিল্প ভাস্কর্য নিয়ে পড়াশুনা করেন তাদের মাথায় প্রশ্ন জাগবে, লিওনার্দো বিখ্যাত হলেন কী করে! এত কম কাজ করে! সারাজীবনে তার কোন বাঁধা প্রতিবন্ধকতা ছিলনা।

মোনালিসা, ‘আহা মরি!’ কোন ছবি নয়। যারা আজ থেকে ৫০০ বছর আগে নানা শিল্পীর কাজ দেখেছেন, সেইসব কাজের পাশে মোনালিসা একদমই বেমানান। এই সব সত্য গত ৫০০ বছরে, নানা তথ্যে প্রশ্ন হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। অথচ, মোনালিসা ও লিওনার্দো ভাগ্যের জোরে জগৎবিখ্যাত হয়ে বসে আছেন। সাধারণ মানুষ তাকে ভগবান জ্ঞানে পূজা করে। তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুললে রেগে যান। মোনা লিসার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুললে লাল চোখ দেখান।
মুশকিল হল, সাধারণ মানুষের ভাবনায় সভ্যতা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি আটকে গেলে সমাজের পতন অবশ্যাম্ভাবী। ধ্রুব কোন জিনিস নেই। সব জিনিস বা বস্তুর স্বচ্ছতা আবিষ্কার করে চলতে হয়। বিজ্ঞান, গবেষনা, বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়।

'মোনা লিসা' Mona Lisa, যার মানে 'মহাশয়া লিসা'।  মোনা ইংরেজীতে  Madam আর ‘লিসা,’ একটি স্ত্রী জাতীয় নাম। ইতালীয় উচ্চারন ‘লিজা’। হিব্রু নাম ‘এলিজাবেথ’ (a Hebrew baby name Elizabeth, from Elisheba, meaning either oath of God In German The meaning of the name Lisa is: Devoted to God.) ভেঙ্গে এলিজা, এলিজা ভেঙ্গে লিজা। কোথাও লিসা।
মন, মনা,এরকম শব্দ, আমরা আদুরে ও চলিত ভাষায় ছোটদের ডাকি। কখনো এর ব্যবহার প্রেমিকা, স্ত্রী কে অশালীন অর্থেও ব্যবহার হয়। ইতালীর ভাষায় 'মোনা' র চলিত প্রয়োগ অশালীন। wikipedia সূত্রে দেখি, মোনা শব্দের অর্থ নারীর যোনি, বা অপদার্থ মানুষকে গালিতে ব্যবহার ইত্যাদি Mona in Italian meaning,  (regional, chiefly Triveneto, vulgar, figuratively, derogatory) cunt, pussy,  idiot, silly, dupe)।

 মোনালিসা পেইন্টিং এর 'মোনা লিসা' শব্দ প্রয়োগ এসেছে রেনেসাঁর ঐতিহাসিক Giorgio Vasari (1511-74 born in Arezzo, a town in central. Italy), জর্জিও ভাসারির লেখা থেকে। তিনি লিখেছিলেন, "Leonardo undertook to paint, for Francesco del Giocondo, the portrait of Mona Lisa, his wife." এই মোনালিসা থেকে পরিচিতি পেয়েছে ঊনিশ শতকের পর। কিন্তু পরিচিত লোকেরা ‘ম্যাডাম লিসা’ ১৫০৩ সাল থেকে বলত। জর্জিও ভাসারি তার লেখা প্রকাশ করেছিলেন ১৫৫০ সালে। সেই বই ইংলিশ তর্জমা হয় ১৯৯১ সালে। অর্থাৎ মোনালিসা নাম আগে কেউ জানতনা।

যতটুকু জানা যায়, এক সিল্ক ব্যবসায়ী, নাম ফ্রান্সেসকো জিওকন্ডো (Francesco Del Giocondo)। তিনি উচ্চবিত্ত পরিবারের। তার সাথে তার চেয়ে বয়সে অনেক কম এক তরুণী, বছর ১৫ র, নাম লিজা (ইতালীয় উচ্চারণ) গেরারদিনি, (জন্ম ১৪৭৯, Lisa del Giocondo née Gherardini- Born: June 15, 1479 – July 15, 1542 , of Florence and Tuscany) বিয়ে হয় (March 5, 1495)। লিজার পরিবার ও সম্ভ্রান্ত পরিবার তবে ফ্রান্সেসকো জিওকোন্ডোর মত ধনী নয়। বিয়েতে বড় রকমের পণ দেওয়া হয়েছিল। কোন দাবী ছিলনা।   লিজা র স্বামী ফ্রান্সেসকো (Francesco di Bartolomeo di Zanobi del Giocondo, সংক্ষেপে Francesco del Giocondo, Florence, এ ১৪৬৫  সালে জন্মান ও মারা যান Florence,এ ১৫৩৮ সালে) ১৪৯৫ সালে লিজাকে বিয়ে করেন, ফ্রান্সেসকোর বয়েস তখন তার ৩০ বছর। ফ্রান্সেসকো লিজাকে বিয়ের আগে আরো দুটি বিয়ে করেছিলেন, একটি ১৪৯১ Camilla di Mariotto Rucellai, অন্যটি Tommasa di Mariotto Villani ১৪ ৯৩ সালে। আগের দুটি বিয়েতে সন্তান জন্ম দেবার সময় তার স্ত্রীরা মারা যান। তার একটি ছেলে ছিল। লিজা বিয়ের পর সেই সন্তানের বড় করে তোলার ভার নিয়েছিলেন। সন্তান আঁতুর ঘরে মরে যাওয়া বা প্রসব করতে গিয়ে মহিলাদের মৃত্যু  হওয়া তখনকার দিনে আকছার হত। ফ্রান্সেসকো সেই সময় সন্তান জন্মের পর খুশী উদ্‌যাপন করতেন। এরকম ২য় বার লিজার সন্তান হওয়ার পর খুশী উদ্‌যাপন করার জন্য ও তাদের একটি নতুন বাড়ি কেনা হয়েছিল তার খুশীতে  এক উৎসব আয়োজন করেন।

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির (15 April 1452 – 2 May 1519) বয়েস তখন প্রায় ৫২ বছরের কাছাকাছি। যথেষ্ট খ্যাতি ও অর্থের মালিক ছিলেন। ফ্রান্সেসকো লিওনার্দোকে তার স্ত্রীর একটা প্রতিকৃতি  তৈলচিত্রে এঁকে দিতে বলেন।  লিওনার্দো এই কমিশন কাজটি পেশাগত ভাবে গ্রহন করেন। ফলে ২৪ বছরের ২সন্তানের মা,মাঝ খানে একটি মেয়ে মিস ক্যারিজ হয়ে গেছে। এক সন্তান স্তন পান করার সময় থেকে লিওনার্দোর স্টুডিওতে ছবি আঁকার জন্য উপস্থিতি ও ঘন্টার পর ঘন্টা বসতে হত। সন্তান প্রসবের পর, বা গর্ভবতী রমণীর শরীরে সাধারণ সময় থেকে একটু আলাদা দৃশ্যগত পার্থক্য হয়। লিওনার্দো, লিজার প্রতিকৃতি আঁকতে  ৩ বছরের মত সময় নিয়েছিলেন সম্পূর্ণ করতে। অর্থাৎ এই সময়কালে লিজা আবার মা হয়েছিলেন। লিজার ৫টি সন্তানের মা ছিলেন। ফলে লিওনার্দোর লিজার ছবি আঁকার সময়কালে লিজার স্তন দানের ভেজা ও নরম শরীর এবং গর্ভবতী কালের শরীরে ও মুখের গঠন লিওনার্দোর পেইন্টিং য়ে প্রতিফলিত হয়েছিল। লিও নার্দো দ্য ভিঞ্চি তার মোনালিসা পোর্ট্রেটে বা তার খেরো খাতায়, মোনালিসার কোন স্টাডি স্কেচ করেননি, তারিখ লিখেননি। উল্লেখ করেননি। ফলে, অনেক লোক নানা প্রশ্ন তুলতে পারেন। কখন আঁকা, তারিখ, কার আঁকা ইত্যাদি প্রশ্ন।

এসব গল্প, সাধারণ মানুষের শোনার দরকার হয়নি। সারা পৃথিবী লুভ্যর মিউজিয়ামে, বুলেট প্রুফ মোনালিসার গল্পই জানে। লিওনার্দোর অবিস্মরণীয় ছবি। সাধারন মানুষের বিচার ক্ষমতা নেই। থাকেনা। সে সব সময় পূর্ব অনুমান, বা সংস্কার মেনে চলে। তাকে যদি বলা হয় এই ফুলটা এই এই গুণ আছে সে কোন প্রশ্ন করবেনা।মোনালিসা ছবিটি সুন্দর। সাধারণ মানুষ মেনে নিয়েছে। এবং যোগ করেছে আরো নানা আবেগ ও গুজব।
নানা ডকুমেন্ট পড়লে বোঝা যায়। ১৮ বছর মিলানের কোর্ট আর্টিস্ট , মানে রাজার দরবারের শিল্পী হিসাবে কাজ করার পর, লিওনার্দো  শূন্য হাতে ফ্লোরেন্সে এসেছিলেন। হাতে একটা কানাকড়িও নেই। ফ্লোরেন্সের এক গৃহবধুর ছবি তিনি আঁকতে চাননি। কারণ তার সম্ভ্রমে বেঁধেছিল। তিনি আগে এর চেয়ে অনেক বড় বড় খ্যাতি সম্পন্ন কাজ করেছেন। তার কাছে অনেক টাকা কড়িও এসেছিল। এতটা খারাপ অবস্থা তার হয়নি। উপায়ন্তর না দেখে লিজা ঘেরারদিনি, ফ্রান্সেসকো জিওকোন্ডোর ২৪ বছরের গৃহবধুর ছবি আঁকতে বাধ্য হয়েছিলেন। পিছনে একটা লোভও ছিল, যে বড় লোকের কাজ করে যদি কিছু বড় বড় কাজের কমিশন পাওয়া যায়। এছাড়া ফ্রান্সেসকো জিওকোন্ডো (Francesco del Giacondo) ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। তিনি লিওনার্দোকে অনেক টাকাই দিয়েছিলেন। কারণ লিজাকে তিনি ভালবাসতেন। সন্দেহের উপরে দেখতেন।
যখন লিওনার্দো ২৫ বছরের গৃহবধুকে দেখেন, তখন সেই গৃহবধুর রূপ ও শরীর অন্য গল্প শুরু করে দিয়েছিল। শিল্পীর সাথে মডেল কত দূরে থাকে ইতিহাস বলতে পারে। এসব ইতিহাস বিস্তারিত বলেনা। এসব শুনতে হয় দুষ্টু লোকের ফিসফিসানি থেকে। অন্ধকারে কে কি করে আপনি প্রমাণ নিয়ে বলতে পারেননা।

পশ্চিম লন্ডনের আইলওয়ার্থ Isleworth নামে একটি শহরে এক শিল্পী ও কলা সমালোচক থাকতেন, তার নাম Hugh Blaker। ১৯১৪ সালে তিনি একটি মোনালিসা কেনেন। এই মোনা লিসা, লুভ্যরের (১৫০৩ - ১৭) মোনালিসার মতন নয়।পপলার কাঠের প্যানেলে নয়। এটা ক্যানভাসে করা। এর দুইদিকে দুটি কলাম/ বা স্তম্ভ আছে। আর পিছনে দৃশ্যচিত্র একদম সাধারন।আকৃতিগতভাবে ক্যানভাসের ছবিটি অধিক চওড়া। ব্ল্যাকার জানালেন, ছবিটি একটি বিশেষ সংগ্রহ (Somerset aristocratic collection) থেকে এসেছে। ১৯৬২ সালে লন্ডনের এক সংগ্রাহক Henry Pulitzer সেই মোনালিসা কিনে নেন। তিনি আবার কতগুলি গ্যালারীতে (Phoenix, Arizona) ব্যবসায়িক ভাবে প্রদর্শন করেন। তখনও জানা যায়নি এটা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির করা কাজ।
ফলে, লোকে প্রথমে মানতে চাইলনা।

 আইলওয়ার্থের মোনালিসার উপর নানা পরীক্ষায় (laboratory evidence (light to dark ratios across the canvas, X-rays, etc.) )দেখা গেছে এটা লিওনার্দোর আসল কাজ। এরপর আইলওয়ার্থের মোনালিসা ১৯৭০ সালে সুইস ভল্টে (Swiss bank vault, Switzerland) চলে আসে, এবং সাধারণ লোকের দর্শন বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৯ র পর থেকে বিশেষ করে ২০১২র পর বহু সংগঠন, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা আইজল ওয়ার্থ মোনালিসার উপর দিয়ে গেছে। এবং লিওনার্ডো যে প্যাটার্ণ বা জ্যামিতি তার ছবিতে ব্যবহার করতেন সেসব সহ পন্ডিতরা বলেছেন (Swiss Federal Institute of Technology in Zurich)এটা আসল লিওনার্দোর কাজ।এইসব পরীক্ষা নীরিক্ষার সকল ডকুমেন্ট নিয়ে ২০১৪ সালে একটি ভিডিও "The Mona Lisa Mystery" প্রকাশ হয়েছিল জনস্বার্থে। সেটা নানা বিখ্যাত চ্যানেলে পরিবেশন হয়। ২০১৭ সালে একটি ঐতিহাসিক নথি Gérard Boudin de l'Arche প্রকাশিত হয়, তাতে বলা হয়েছে লুভ্যরের মোনালিসার আগেই লিওনার্দো আইলওয়ার্থে প্রাপ্ত মোনালিসা এঁকেছিলেন ও এটি আসল। আইলওয়ার্থের ছবিটি।
লিওনার্দো 'ভিট্রুভিয়ান ম্যান' বলে একটা জ্যামিতি আবিষ্কার করেছিলেন, যেখানে একটি লোক হাত পা প্রসারিত করে একটি বৃত্তে আছে। “He has made extended studies of the geometry of Leonardo’s Vitruvian Man” - a sketch of a youth with arms and legs extended , এটি তিনি ছবি আঁকার সময় মানুষের অ্যানাটমি পারফেকশানের জন্য বানিয়েছিলেন। পন্ডিতগণ সেই জ্যামিতির হিসাব ধরেওপরীক্ষা করে নিশ্চিন্ত হন আইলওয়ার্থের মোনালিসা আসল মোনালিসা।



মোনালিসার দুটি ছবিই লিওনার্দো এঁকেছিলেন ফ্লোরেন্সে বসে। একটা সাধারণ, ১৫০৩ সালে আরেকটা ১৫০৩ থেকে ১৫১৭ সাল অবধি ও পরেরটা লুভ্যরে স্থান পেয়েছিল। পরেরটা, নাকি লিজার প্রতিকৃতি নয়। লিজার মত দেখতে। কারণ অনেক। ১। লিজা লিওনার্দোকে  প্রতিকৃতি বানাবার জন্য ১৫০৩ থেকে ১৫১৭ অবধি ১৪ বছর ধরে সিটিং দিতে এসেছিলেন এটা অবিশ্বাস্য। এর কোন ফিসফিসানিও নেই। ২। লুভ্যরের ছবিটাতে অতি পাতলা আস্তরনে কাজ করেছিলেন। ফলে লম্বা সময় ছিল ফিনিস করার। ৩। লুভ্যরের মোনালিসার বয়েস বেশী। ৪। লিওনার্দোর একটা স্টাইল ছিল মহিলা মুখ আঁকার, একটা হাসি- ঠোটের কোনে অল্প করে ধরতেন। আর চোখের ভ্রু দুদিকে এমন ভাবে ছায়া ফেলতেন তাতে দূঃখি বা সুখী দুটোই বোঝানো যেত। ৫। তিনি ছবির মধ্যে কালচে করে ধোয়ার মত কালো রঙ ব্যবহার করতেন ছায়া বা অন্ধকার বোঝাতে। ৬। তিনি একটি মহিলা মডেল মুখ বানিয়েছিলেন। কোথায় তার নাম,সই, তারিখ, ইত্যাদি কিছুই ছবিটিতে লিখেননি।

একটা রীতি সু প্রাচীন কাল থেকে চালু ছিল, যে, যে ছবি চাহিদা সৃষ্টি করে, বা করতে পারে, সে ছবিগুলি শিল্পীরা একাধিক প্রস্তুত করেন। শিল্পীরা যারা স্বাধীন, কোন স্পনসর বা পৃষ্ঠপোষকতা পাননা তারাই জীবিকার স্বার্থে একাজ করতেন। লিওনার্দো আর্থিক অস্বচ্ছলতা দেখে একাধিক মোনালিসা বা নারী প্রতিকৃতি প্লান করে থাকতে পারেন। ও মোনালিসা নয়, যে কোন একটি মেয়ে মুখ হিসাবেও তিনি পেইন্টিং করে থাকতে পারেন।

আরেকটা বিষয় হল, লিওনার্দো, ফ্লোরেন্স এ তার জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য না পেয়ে, ১৫০৬ সালে Charles d’Amboise, মিলানের গভর্ণরের অনুরোধে  ফ্রান্সে (France,small Loire chateau) চলে যান তার সকল কাজ কর্ম নিয়ে। ১৯১৩ সালে একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি Giuliano de Medici in Rome তার পৃষ্ঠপোষকতায় পপলার কাঠের প্যানেলে করা মহিলা প্রতিকৃতিতে কাজ শুরু করেন । ১৫১৭ সালে একজন কার্ডিনালকে এক মহিলা প্রতিকৃতি দেখানো হয়( a certain Florentine lady)  সম্ভবত ছবি বিক্রীর উদ্দেশ্যে। এটা যে Giuliano de Medici. র টাকায় তা নথিভুক্ত হয়। ১৫১৮ সালে সালাইএর মাধ্যমে মহিলা চিত্র খানি (মোনালিসা) টাকা লেনদেনের পর ফরাসী রাজার সংগ্রহে অন্তর্ভূক্ত হয়ে লুভ্যরে আসে।লিওনার্দো ১৫১৯ নাগাদ ফ্রান্সেই মারা যান ।

১৬২৫ সালে, বাকিংহামের (Buckingham) ডিউক ইংল্যান্ডের রাজা চার্লস এক (King Charles I) এর পক্ষ থেকে একটা অনুরোধ  রাজা  ত্রয়োদশ লুইকে( King Louis XIII) পাঠাতে বলেন। রাজা লুই তখন কিছু শিল্প অনুরাগী হয়ে উঠেছেন। তাকে মোনা লিসা সংগ্রহ করতে বলেন। ১৬৫০ সালে , মোনা লিসা পেইন্টিংটি ফ্রাঙ্কোইস এক এর বড় সংগ্রহের ভান্ডার হিসাবে ইতালী থেকে লূভ্যরে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে বেশ কিছু কাল অবহেলিত ও পরিত্যক্ত হয়ে থাকে। এরপর সেটি আবার চতুর্দশ লুই ইয়ের ( Louis XIV)বাড়িতে আশ্রয় পায়. ১৬৯৫ এ এটি আবার  Petite Galerie, Versallies তে ঝুলানো হয়। সেখান থেকে ১৭০৬ সালে প্যারিসে।Tuileries palace এ। সেখান থেকে আবার Versallies এ ১৭০৯ সালে। ও সেখানে  ১৭২০ অব্ধি থাকে। ১৭৮৯ সালে রাজতন্ত্র সমাপ্ত হলে, সকল পেইন্টিং ফরাসী সরকারের সম্পত্তি হয়ে যায়। নেপোলিয়ন বোনাপার্টে (Napoleon Bonaparte)যখন ভারসেলিজে র রাজপ্রাসাদে (Tuileries palace এ) ছিলেন তখন ম্যাডাম লিসা তার শোবার ঘর শোভা বর্ধিত করে রেখেছিল ১৮০০ সাল থেকে। নেপোলিয়ন একে 'ম্যাডাম লিসা' বলে অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন। সেখান থেকে আবার লুভ্যরে যায় ১৮০৪ সালে।সেখানেই শতাব্দী ভর স্থান হয়, শুধু ফ্রাঙ্কো প্রুশিয়ার যুদ্ধ ( Franco- Prussian war) ১৮৭০ থেকে প্যারী কমিউন ( Paris Commune)  কিছুদিন সুরক্ষার জন্য সরিয়ে নেওয়া হয় সাময়িক।Arsenal at Brest.।
আর এদিকে এক ইংলিশ সম্ভ্রান্ত সাহেব লিজা জিওকোন্ডার পোর্টেট নিয়ে চলে আসেন ইংল্যান্ডে।

লিওনার্দো নিজে মোনালিসার দুটি ছবি করেছিলেন, এটা ঘটনা প্রমাণিত।  একটা ক্যানভাসে অন্যটি পপলার কাঠের প্যানেলে। আগেকার দিনে ক্যানভাস ছাড়াও ছবি আঁকা নানা বস্তুর উপর হত। দেওয়ালে, কাঠের প্যানেলে/ ইত্যাদি। বলা বাহুল্য আঁকার জায়গাটিকে, পট এর জমিটিকে নানা উপকরণ দিয়ে তৈরি করে নিতে হত। কাঠের উপর যে ছবি এঁকেছিলেন, সেটি তার কমিশন কাজ ছিলনা। সেটি ছিল লম্বাটে ধরণের। এবং সেটিকে নিয়ে পরবর্তী কালে নানা গল্প তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটি মোনালিসার আসল ছবি নয়। সেটি নানা জায়গা ঘুরে লুভ্যরে স্থান পেয়েছিল। অগাস্টিনো (Agostino Vespucci was an Italian chancellery official, clerk) ১৫০৩ সালেই একটি লিজা জিওকোন্ডোর প্রতিকৃতি পেইন্টিং শুরু করা ও ইচ্ছাকৃত ফেলে রাখা দেখতে পেয়েছিলেন, এমনটি তিনি তার এক সরকারি তথ্যে লিখে ছিলেন। যে তথ্য  ‘Heidelberg Document’তথ্য নামে পরিচিত।


তৎকালীন সময়ের লিওনার্দোর জীবনীকার Giorgio Vasari,( জন্ম১৫১১- মৃত্যু ১৫৭৪) বলেছেন লিওনার্দো মোনালিসা পেইন্টিং শুরু করেছিলেন ১৫০৩ সালে। একটা ক্যানভাসে শুরু করেছিলেন ও একটু বড় করে, যাতে ফ্রেম করার সময় বাড়তি অংশ ব্যবহার করা যায় কোন অসুবিধা না ঘটে। আরেকটি ছবি সমাপ্ত না করেই রেখে দেন। ছবিটি লিওনার্দোর স্টুডিওতেই ছিল। এটি পপলার কাঠের প্যানেলে তেল রঙ দিয়ে আঁকা শুরু করেছিলেন। এই দুটি ছবিতে বিস্তর ফারাক ছিল। একটি ছবি লিজার স্বামীর টাকায় করা। ১৫০৬ সালের মধ্যে ডেলিভারি দিয়ে দেওয়া হয়ে থাকবে। সেটা সাধারণতঃ লিওনার্দোর কাছে না থাকার কথা। কেননা অর্ডারি ছবি, টাকা নিয়ে ছবি দিয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয় ছবিটি সম্ভবত লিজার পোর্ট্রেট করার বাইরেও অনেক কৌশল অবলম্বন করেন। এবং ১৫১০ সাল থেকে ১৫১৬ সাল অবধি তাতে কাজ করেন সময়ে সময়ে। এবং দ্বিতীয় ছবিটি তিনি তার নিজস্ব সম্পত্তির মতোই ঘরে রেখে দেন ও অনেক ছবির মধ্যে ছবিটির অস্তিত্বও তিনি ভুলে যান কয়েক বছর। মৃত্যুর আগে ১৫১৭ সালে, উনি মারা যান ১৫১৯, হঠাৎই কাঠের প্যানেলে আঁকা ছবিটি লিওনার্দো তার ঘরে আবিষ্কার করেন। ও খুবই পাতলা লেয়ার দিয়ে কাজ করেন। এই ছবিটিই লূভ্যর Louvre মিউজিয়ামে আছে। যেহেতু দুটো ছবি সেই হেতু এর দুটি নাম দেওয়া হয়েছে। লুভ্যরের Louvre ছবিটাকে di Mona Lisa বা মোনা লিসা বলা হয়। আর আসল যে ছবিটা লিজা জিওকোন্ডো র সেটাকে the Gioconda বা জিওকন্ডো বলে। লূভ্যরের যে ছবিটা নানা প্রহড়ায় দর্শকের জন্য খোলা আছে সে ছবিটা লিজার আসল নয়। এই কাঠের প্যানেলে করা ছবিতে লিওনার্দো কিছু পরীক্ষা মূলক কাজ, রঙ ও রুপকল্প নিয়ে অতিরিক্ত নির্মাণ যোগ করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ লুভ্যরের ছবি- মোনালিসা নিয়েই আগ্রহী।

 রাফায়েলের কালি কলমের স্কেচ ১৫০৪ সালে।

আইলওয়ার্থ মোনালিসার Isleworth Mona Lisa মুখ ও হাতের অংশ লিওনার্দো করেন, কিন্তু বাকী শরীরটা লিওনার্দোর ছাত্ররা করে থাকতে পারেন।কেননা অর্ডারি এক গৃহবধূর ছবির কাজ লিওনার্দোর পছন্দ ছিলনা। ১৫০৪ সালে, রাফাএল Raphael, লিওনার্দোর সমসাময়িক শিল্পী ও ছাত্র, লিওনার্দোর মোনালিসা দেখে তিনি নিজেও  কালি কলমে একটা স্কেচ করেন। এই স্কেচটাও লুভ্যরে র মিউজিয়ামে আছে। রাফায়েল যে স্কেচটি করেছেন, সেই স্কেচটিতে আইলওয়ার্থের মোনালিসা দেখে করেছিলেন। সেখানে রাফায়েল ছবিতে যে স্তম্ভ রয়েছে , রাফায়েল সেটি ও তার স্কেচে রাখেন। ফলে লূভ্যরে যে মোনালিসা তা কিন্তু আসল নয় প্রমাণ হয়ে যায়। রাফায়েলের স্কেচ বলে দিচ্ছে তিনি লূভ্যরের মোনালিসা সেই সময় দেখতে পাননি লিওনার্দোর স্টুডিওতে।

ঊনিশ শতক থেকে সাধারণ পাবলিক ভিউ বা দেখার জন্য মোনালিসা খুলে দেওয়া হল। এই শতাব্দীতে শিল্প আন্দোলনের রোমান্টিসিজম মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলে ছিল। মানুষ মোনা লিসার মধ্যে পৌরাণিক চরিত্র বা মিথ, রাজাদের জীবনের জয় বিজয় ইত্যাদি নানা কোন থেকে লিওনার্দোর প্রশংসা ও মোনালিসার স্তুতি কুড়াতে লাগল।


   ________________________________________________________________

No comments:

Post a Comment