গল্প
বি ভা ব সু দে
।। ওরা, আমরা ও একটি ছোট্ট পুতুল ।।
টিক টিক টিক টিক ! দশ, নয়, আট...
ভিড়ে থিকথিক করছে চারপাশটা। ভুবনেশ্বরের ইউনিট-১ এর বাজার। রাস্তার সামনে থেকে ফুটপাত পেরিয়ে একটা সরু কাঁচা রাস্তা সোজা ঢুকে গেছে বেশ কিছুটা। দুপাশে সার দিয়ে ছোটবড় দোকান। তারপর সেই রাস্তাটা গাছের মতো ডালপালা মেলে এগিয়ে গেছে আরও তিনদিকে, সেই তিনদিক থেকে আরও অনেকদিকে। গিজগিজ করছে দোকান, দোকানি, মুটে আর খদ্দের। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে, তাই বেশ প্যাচপেচে কাদা জায়গায় জায়গায়। মাঝে মাঝে পা পিছলে যায়।
আমি যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছি, তার ঠিক উল্টোদিকে একটা মুদির দোকান। কী নেই সেখানে, চাল-ডাল থেকে আখরোট, পাপড় সব। বেশ কিছু লোকের ভিড় সামনাটায়। দোকানের মালিক কোনও এক খদ্দেরের জিনিসের ফিরিস্তি হাতে একনাগাড়ে বলে চলেছে, "ডালি গোটে কিলো। চাউল পাঞ্চ কিলো। কিশমিশ...", আর কর্মচারী ছোকরাটি সমানতালে জিনিসগুলো ভরে দিচ্ছে থলের ভেতর।
আমার পেছনে ডানদিকে একটা কাঁসপেতলের দোকান আর বাঁয়ে কাপড়ের। দুটোর প্রায় মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি আমি, অপেক্ষা করছি। সাত, ছয়, পাঁচ...
অপেক্ষা সেই চরম মুহূর্তের। সেই মুহূর্ত যার জন্যে গত ছয়মাস ধরে তিলতিল করে তৈরী করেছি নিজেকে। আর মাত্র কয়েকটা সেকেন্ড। আমার বুকের ভেতরেও যেন কিছু একটা ঘড়ির কাঁটার মতোই কাঁপছে... টিক টিক টিক টিক ! চারপাশের সদ্য বৃষ্টিভেজা হাওয়ায় কেমন একটা আবছা ধোঁয়াটে প্রলেপ। চোখের সামনে সব কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে। হঠাৎ যেন সময়টা থেমে গেছে !
একটু একটু করে মনে পড়তে লাগল সবকিছু। সেই সব আঘাত, সেই অপমান, সেই রক্তাক্ত লাশগুলো আর সেই বেআব্রু নগ্ন শরীরগুলো। সব।
সালটা ১৯৯২। আমি তখন ক্লাস সেভেনে। আর দিদি কলেজে। আব্বা সরকারি কারখানায় ম্যানেজার ছিল। বেশি দূরে নয়, আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরেই কারখানা। গ্রামের অনেকেই কাজ করত সেখানে। আমার এখনও মনে আছে, আব্বা আমাকে রোজ সকালে বাইকে স্কুলের সামনে নামিয়ে দিয়ে নিজের কারখানার দিকে চলে যেত। আমার ফিরতে ফিরতে বিকেল আর আব্বা ফিরত সন্ধে সাতটা নাগাদ। আম্মি রোজ নতুন কিছু বানিয়ে রাখত জলখাবারে।
সেদিন সোমবার ছিল, ৭-ই ডিসেম্বর। শীতের দিন, তাড়াতাড়িই রোদ পড়ে যায়। আমি বিকেল বিকেলই ফিরেছিলাম, দিদিও চলে এসেছিল একটু পরেই। আম্মি লুচি আর হালুয়া বানিয়েছিল সেদিন। আব্বার একটু দেরিই হচ্ছিল আসতে। কাজের চাপ বেড়েছে আজকাল, বলছিল বেশ কদিন ধরেই। বছরের শেষ, নানান ধরনের ঝোটঝামেলা তো থাকেই। আমরা অপেক্ষা করছিলাম---লুচি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে যে ! তবে খুব বেশি দেরি হল না সেদিনও। পৌনে আটটা নাগাদ এসে পড়েছিল আব্বা---কিন্তু বাইকে নয়, সাদা কাপড়ে ঢাকা লাশ হয়ে।
আম্মি বেহুশ হয়ে পড়ে গেছিল দরজার সামনেই। দিদি কাঁদছিল, চিৎকার করে কাঁদছিল।
কারা ধারালো ছুরি দিয়ে গলাটা ফাঁক করে দিয়েছিল আব্বার। সারা বুকজুড়ে শুকনো কালচে রক্ত। যারা নিয়ে এসেছিল, তাদেরই একজন, রহিম শেখ বলছিল, "এদিকেও আঁচ লাগতে শুরু করেছে। আমরাও ছাড়ব না।"
আরেকজন কে যেন বলল, "কিন্তু এখানে কেন ? ঝামেলা তো গতকাল সেই অযোধ্যায় হয়েছে।"
রহিম শেখ জবাবে আরও কিছু একটা বলেছিল, মনে নেই। কীসের আঁচ, কীসের ঝামেলা, কোথায় অযোধ্যা, আমি কিছুই জানতাম না। বুঝতেও পারছিলাম কারা কেন মারল আব্বাকে। শুধু একটা জিনিসই মাথায় পাক খাচ্ছিল তখন, কাল থেকে আর কেউ সকালে বাইকে করে স্কুলের সামনে নামিয়ে দেবে না আমাকে। দিদি তখনও চিৎকার করে কাঁদছে, আম্মি অজ্ঞান। আমি পাথুরে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি আব্বার দুফালি হয়ে যাওয়া গলাটার দিকে। দিদির মতো কাঁদতে চাইছিলাম আমিও, কিন্তু কান্না পাচ্ছিল না।
আমার চারপাশে সব কেমন যেন থেমে গেছিল---স্থির হয়ে গেছিল আব্বার মতোই। গভীর এক নৈঃশব্দ যেন ঝিঁঝির ডাকের মতো বাজছে, ঝিনঝিন করছে মাথাটা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে বসলে যেমন লাগে, আমার ঠিক তেমনই মনে হচ্ছিল। যেন একটা খোয়াব দেখছিলাম এতদিন। আব্বা, আম্মি, দিদি, আমি---একটা সুন্দর স্বপ্ন।
উঠোনে নেমে আব্বার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাইরে তখন কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। খুব শীত করছিল আমার, খুব বেশিই।
"মসজিদটা তো ওরাই ভেঙেছে।" রহিম শেখের কথাগুলো যেন অনেকদূর থেকে ভেসে আসছিল। "এখানেও আব্দুল মিঁয়ার গলায় ছুরি দিয়ে শুরুটা কিন্তু ওরাই করল।"
ওরা মানে কারা ? কোন মসজিদ ? জানতাম না, কিছুই জানতাম না। রান্নাঘরে আব্বার জন্যে ঢাকা দেওয়া লুচিগুলো বোধহয় নেতিয়ে পড়েছে এতক্ষণে। চারপাশে ঘন অন্ধকার। আকাশে টিমটিম করে জ্বলছে তারাগুলো। আর আমাদের উঠোনে একটা লাশ---যাকে আজ সকালেও আব্বা বলে ডেকেছি।
ঘরের ভেতর থেকে চুঁইয়ে পড়া হলদে আলো ছড়িয়ে পড়ছিল আব্বার ওই সাদা কাফনের ওপর। মাঝে মাঝে কালচে লাল রক্তের ছোপ।
থানায় রিপোর্ট করা হয়েছিল সেদিনই। দারোগা অজিত সিং বলেছিল, "কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। যারা এই কাজ করেছে বেশিদিন লুকিয়ে বেড়াতে পারবে না।"
বেশ ভালো লোকটা। লম্বা চওড়া গড়ন, ঠোঁটের নিচে নিখুঁতভাবে ছাঁটা একটা গোঁফ। সরু চোখদুটোতে কেমন একটা শিকারী চাউনি। ভরসা পেয়েছিলাম আমরা। আব্বা তো আর ফিরবে না, তবু খুনিদের শাস্তি যদি হয়, অন্তত কিছুটা সান্ত্বনা তো পাব। সেই অল্প বয়সেও আমার অজিত সিং-কে দেখে মনে হয়েছিল লোকটা 'ওরা' আর 'আমরা'-র বাইরের একটা মানুষ। অনেকটা হিন্দি সিনেমার হিরোদের মতো।
বেশ জোরকদমেই শুরু হয়েছিল আব্বার খুনের তদন্ত। অজিত সিং মাঝেমাঝেই আসত আমাদের বাড়িতে। আব্বার সম্পর্কে, আব্বার বন্ধু, কারখানার লোকেদের সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করত। দিদিই জবাব দিত। আম্মি তখনও কথা বলার অবস্থায় নেই। হাতে একটা পুলিশি খাতা নিয়ে অজিত সিং-এর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকত এক হাবিলদার, তরতর করে লিখে নিত দিদির বয়ানগুলি। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখতাম। মনে হতো আর ক'টা দিন, তারপরেই শাস্তি হবে সেই শয়তানগুলোর। রহিম শেখ যাদের 'ওরা' বলে !
বেশ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছিল অজিত সিং। দিদিকে প্রায়ই থানায় যেতে হতো তদন্তের ব্যাপারে। আমিও যেতে চাইতাম, দিদি নিত না। বলত, "আম্মিকে দেখবে কে ?" আমি বাড়িতে থেকে আম্মিকে দেখতাম আর দিদি আব্বার খুনের তদন্ত দেখত। একদিন সন্ধে নাগাদ হঠাৎ পুলিশের গাড়ি এসে থামল আমাদের উঠোনের সামনে---যেখানে কয়েক সপ্তাহ আগেই আব্বাকে শুয়ে থাকতে দেখেছিলাম। গাড়ির ভেতর থেকে সেই হাবিলদার ডাক দিল, "রাজিয়া, একবার থানায় যেতে হবে। কিছু লোক ধরা পড়েছে। একটু এসে দেখতে হবে এদের কাউকে তোমরা চেনো কি-না।"
আমার বুকের ভেতর কী একটা যেন মোচড় দিয়ে উঠেছিল সেদিন। ওরা ধরা পড়েছে ! এবার নিশ্চয়ই ফাঁসি হবে ওদের। দিদি মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেল, আম্মিকে আমার জিম্মায় রেখে। "দরজাটা লাগিয়ে রাখিস, আমি এসে আম্মিকে ওষুধটা খাইয়ে দেব।"
দিদির কথামতো লাগিয়েই রেখেছিলাম দরজাটা। কিন্তু ওষুধের সময় পেরিয়ে যাবার পরও দিদি আসেনি। রহিম শেখ এসেছিল রাত এগারোটা নাগাদ। হন্তদন্ত হয়ে। "জলদি চল বেটা। সব্বোনাশ হয়ে গেছে।"
বুঝতে পারিনি কিছুই। আম্মি তখন পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে। আমি দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। ছুটতে লাগলাম রহিম শেখের সঙ্গে। কোথায় যাচ্ছি জানি না, শুধু একটা অজানা 'সব্বোনাশ'-এর ভয়ে বুক কাঁপছে। বেশ অনেকটা গিয়ে রায়দের পুরোনো আমবাগানের সামনে থামলাম আমরা। দশ পনেরোজন লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। ভিড় ঠেলে এগোতেই চোখে পড়ল দিদি---শুয়ে আছে। পাথরের মতো কিংবা আব্বার মতো স্থির, নিশ্চল হয়ে। গলায় দড়ি দেবার কালচে দাগ, গায়ের চুড়িদারটা জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। ভিড় থেকে কে একজন যেন বলল, "ওই আমগাছে ফাঁসি দিয়েছিল রাজিয়া। সইদুর প্রথম দেখতে পায়।"
দিদি নিজের গলায় ফাঁসি দিয়েছিল ! কিন্তু ফাঁসি তো হওয়ার কথা ছিল ওদের, যারা আব্বাকে খুন করেছিল। বুঝতে পারছিলাম না, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। রহিম শেখ আবার সেই ঘড়ঘড়ে সুরে বলতে লাগল, "ওই শুয়োরের বাচ্চা দারোগাই করেছে, আমি জানি। নিজের জাতের বিপক্ষে কেন যাবে ও ? উল্টো সুযোগ পেয়ে আমাদের মেয়েটাকেই...", গলাটা আরও একদাগ চড়ে উঠল ওর, "ওদের আমরা ছাড়ব না। অনেক হয়েছে, এবার জবাব দিতেই হবে।"
অজিত সিং ! কিন্তু কেন ? সে তো 'ওরা' আর 'আমরা'-র বাইরের একজন মানুষ ছিল। হিসেবগুলো মিলছিল না আমার। আমার সামনে তখন আব্বার কবরের ওপর শুয়ে থাকা দিদির লাশ; একপাশে রহিম শেখ আর একপাশে অজিত সিং। সত্যিই কি তবে 'ওরা' আর 'আমার'-র বাইরে কেউ হয় না ?
সে-রাতে থানায় অনেকবার খবর দেওয়া হলেও কেউ আসেনি। আমিই গেছিলাম পরদিন থানায়। সঙ্গে আমাদের প্রতিবেশী মইদুল। সে-ই কথা বলছিল অজিত সিং-এর সঙ্গে, আমি শুধু চুপ করে দেখছিলাম।
"রাজিয়াকে রেপ করে খুন করা হয়েছে স্যার, রিপোর্ট লেখাতে এসেছি।"
অজিত সিং কেমনভাবে যেন তাকাল আমাদের দিকে। ওর চোখের চাউনি হাবভাব সব কেমন যেন অন্যরকম। "আচ্ছা। যান ওই কনস্টেবল বসে আছে, ওর কাছে রিপোর্ট লিখিয়ে দিন।"
মইদুল সব বলল। যেখানে যেখানে দরকার পড়ল আমিও বললাম। পুলিশের গাড়ি করে সন্ধের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দিদিকে, সেটাও বললাম। কনস্টেবল রিপোর্ট লিখল। বলল, "কিছু খবর পেলে জানানো হবে।" আমরা বেরিয়ে এলাম। মইদুল বেশ কিছুটা সামনে আর আমি পেছনে। থানার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভেতর থেকে একটা গলা শুনতে পেয়েছিলাম সেদিন, অজিত সিং-এর গলা---"লিখেছ তো ঠিকঠাক ? এবার ছিঁড়ে ফেলে দাও।" সঙ্গে বিদ্রুপমাখা একটুকরো হাসির আওয়াজ।
সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম, আমার দুপাশেই রহিম শেখ, অজিত সিং বলে কেউ নেই। শুধুই 'ওরা' আর 'আমরা' !
'ওরা' মারবে আর 'আমরা' মরব ? হবে না, কিছুতেই হবে না। ঠিকই বলেছিল রহিম শেখ, আমাদের জবাব দিতেই হবে। দিয়েছিলাম। মাসখানেক পর একদিন অজিত সিং-এর কোয়ার্টারের সামনেই ওর বুকে শাবল গেঁথে খুন করেছিলাম ওকে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটকে পড়েছিল আমার চোখেমুখে। ঘাসের ওপর গলগল করে ছড়িয়ে পড়ছিল ওই শয়তানের কালচে রক্ত।
আমি গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছিলাম সেদিনই। প্রথমে মুম্বই, সেখান থেকে হায়দ্রাবাদ। সেখানেই দেখা হয়েছিল নেয়ামত খানের সঙ্গে। সে 'আমাদের' লোক ! ওদের ঘেন্না করত। রহিম শেখও করত, জবাব দেওয়ার কথাও বলত, কিন্তু কোনওদিন কিছু করতে দেখিনি রহিম শেখকে। নেয়ামত জবাব দিতে জানত, আর জানত জবাব দেবার মোক্ষম তারিকাও ! লোকটা বয়সে আমার চেয়ে অনেকটাই বড়, কিন্তু বন্ধুর মতো আপন করে নিয়েছিল আমাকে। বলেছিলাম, আমার সব ঘটনাই খুলে বলেছিলাম ওকে। শুনে বলেছিল, "ইনশাল্লাহ। তুমহারে অন্দর সাচ্চা জেহাদ হ্যাঁয়।"
জেহাদ। গা শিরশির করে উঠেছিল শব্দটা শুনে। ধর্মযুদ্ধ। ক্রুসেড। জেহাদ। কয়েক বছর পর নেয়ামতই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল আমার পাকিস্তান যাবার। সেখানে ওর অনেক যোগাযোগ। জেহাদি দলে যোগ দিয়েছিলাম আমি। বছর দুয়েক ট্রেনিং চলেছিল আমাদের। বোমা ছোঁড়া থেকে বোমা বানানো, পিস্তল, রাইফেল চালানো সব শিখেছিলাম সেখানে। আর শিখেছিলাম 'ওরা' আমাদের দুশমন ! ওদের শেষ করাই সাচ্চা জেহাদ। যদি এই জেহাদে জয়ী হও তবে তুমি গাজী আর যদি মারা যাও তবে তুমি শহীদ। বেহেস্তের শ্রেষ্ঠ আসন তোমার জন্যেই পাতা। 'ওরা' আর 'আমরা'-র মাঝখানে কেউ নেই, কিছু নেই। শুধুই জেহাদ। হয় ওরা নয় আমরা।
টিক টিক টিক টিক ! আমার ভারী জ্যাকেটের ভেতর কোমরে জড়ানো একটুকরো জেহাদ। টিক টিক করে এগিয়ে আসছে বেহেস্তের সেই শ্রেষ্ঠ আসন ! আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড, তারপরেই...। ছোটবেলায় দিদির লাশের সামনে, আব্বার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে শোনা রহিম শেখের সেই কথাগুলো মনে পড়ে গেল---"ওদের আমরা ছাড়ব না। অনেক হয়েছে, এবার জবাব দিতেই হবে।" অজিত সিং-কে জবাব দিয়েছিলাম, কিন্তু একটা অজিত সিং-এ কী হবে ? অযোধ্যার ভাঙা মসজিদ, আমার আব্বার গলাকাটা লাশ, দিদির বেআব্রু শরীর আর গলায় দড়ির দাগ, আমার আম্মির কান্না---এসবের জবাব কেবলমাত্র একটা অজিত সিং তো হতে পারে না !
"আঙ্কেল আঙ্কেল, এহা দেখন্তু মোরা ছোটা কান্ধেই।" চমকে উঠলাম। একটা বাচ্চা মেয়ে, হাতে নতুন কেনা একটা পুতুল নিয়ে আমায় দেখাচ্ছে। উজ্জ্বল দুটো চোখ, খুশিতে ঠিকরে পড়ছে। কে ও ? 'ওরা' না 'আমরা' ? কোনও উত্তর খুঁজে পেলাম না। জেহাদ, বেহেস্ত, আব্বা, আম্মি, দিদি, অজিত সিং, রহিম শেখ, নেয়ামত খান---সব কেমন যেন আবছা হতে হতে মিলিয়ে গেল ওই বাচ্চা মেয়েটার 'ছোটা কান্ধেই'-তে, ছোট্ট পুতুলে। চোখদুটো কেমন জ্বালা জ্বালা করে উঠল হঠাৎ।
চার, তিন, দুই...
______________________________________________________________________
বি ভা ব সু দে
।। ওরা, আমরা ও একটি ছোট্ট পুতুল ।।
টিক টিক টিক টিক ! দশ, নয়, আট...
ভিড়ে থিকথিক করছে চারপাশটা। ভুবনেশ্বরের ইউনিট-১ এর বাজার। রাস্তার সামনে থেকে ফুটপাত পেরিয়ে একটা সরু কাঁচা রাস্তা সোজা ঢুকে গেছে বেশ কিছুটা। দুপাশে সার দিয়ে ছোটবড় দোকান। তারপর সেই রাস্তাটা গাছের মতো ডালপালা মেলে এগিয়ে গেছে আরও তিনদিকে, সেই তিনদিক থেকে আরও অনেকদিকে। গিজগিজ করছে দোকান, দোকানি, মুটে আর খদ্দের। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে, তাই বেশ প্যাচপেচে কাদা জায়গায় জায়গায়। মাঝে মাঝে পা পিছলে যায়।
আমি যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছি, তার ঠিক উল্টোদিকে একটা মুদির দোকান। কী নেই সেখানে, চাল-ডাল থেকে আখরোট, পাপড় সব। বেশ কিছু লোকের ভিড় সামনাটায়। দোকানের মালিক কোনও এক খদ্দেরের জিনিসের ফিরিস্তি হাতে একনাগাড়ে বলে চলেছে, "ডালি গোটে কিলো। চাউল পাঞ্চ কিলো। কিশমিশ...", আর কর্মচারী ছোকরাটি সমানতালে জিনিসগুলো ভরে দিচ্ছে থলের ভেতর।
আমার পেছনে ডানদিকে একটা কাঁসপেতলের দোকান আর বাঁয়ে কাপড়ের। দুটোর প্রায় মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি আমি, অপেক্ষা করছি। সাত, ছয়, পাঁচ...
অপেক্ষা সেই চরম মুহূর্তের। সেই মুহূর্ত যার জন্যে গত ছয়মাস ধরে তিলতিল করে তৈরী করেছি নিজেকে। আর মাত্র কয়েকটা সেকেন্ড। আমার বুকের ভেতরেও যেন কিছু একটা ঘড়ির কাঁটার মতোই কাঁপছে... টিক টিক টিক টিক ! চারপাশের সদ্য বৃষ্টিভেজা হাওয়ায় কেমন একটা আবছা ধোঁয়াটে প্রলেপ। চোখের সামনে সব কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে। হঠাৎ যেন সময়টা থেমে গেছে !
একটু একটু করে মনে পড়তে লাগল সবকিছু। সেই সব আঘাত, সেই অপমান, সেই রক্তাক্ত লাশগুলো আর সেই বেআব্রু নগ্ন শরীরগুলো। সব।
সালটা ১৯৯২। আমি তখন ক্লাস সেভেনে। আর দিদি কলেজে। আব্বা সরকারি কারখানায় ম্যানেজার ছিল। বেশি দূরে নয়, আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরেই কারখানা। গ্রামের অনেকেই কাজ করত সেখানে। আমার এখনও মনে আছে, আব্বা আমাকে রোজ সকালে বাইকে স্কুলের সামনে নামিয়ে দিয়ে নিজের কারখানার দিকে চলে যেত। আমার ফিরতে ফিরতে বিকেল আর আব্বা ফিরত সন্ধে সাতটা নাগাদ। আম্মি রোজ নতুন কিছু বানিয়ে রাখত জলখাবারে।
সেদিন সোমবার ছিল, ৭-ই ডিসেম্বর। শীতের দিন, তাড়াতাড়িই রোদ পড়ে যায়। আমি বিকেল বিকেলই ফিরেছিলাম, দিদিও চলে এসেছিল একটু পরেই। আম্মি লুচি আর হালুয়া বানিয়েছিল সেদিন। আব্বার একটু দেরিই হচ্ছিল আসতে। কাজের চাপ বেড়েছে আজকাল, বলছিল বেশ কদিন ধরেই। বছরের শেষ, নানান ধরনের ঝোটঝামেলা তো থাকেই। আমরা অপেক্ষা করছিলাম---লুচি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে যে ! তবে খুব বেশি দেরি হল না সেদিনও। পৌনে আটটা নাগাদ এসে পড়েছিল আব্বা---কিন্তু বাইকে নয়, সাদা কাপড়ে ঢাকা লাশ হয়ে।
আম্মি বেহুশ হয়ে পড়ে গেছিল দরজার সামনেই। দিদি কাঁদছিল, চিৎকার করে কাঁদছিল।
কারা ধারালো ছুরি দিয়ে গলাটা ফাঁক করে দিয়েছিল আব্বার। সারা বুকজুড়ে শুকনো কালচে রক্ত। যারা নিয়ে এসেছিল, তাদেরই একজন, রহিম শেখ বলছিল, "এদিকেও আঁচ লাগতে শুরু করেছে। আমরাও ছাড়ব না।"
আরেকজন কে যেন বলল, "কিন্তু এখানে কেন ? ঝামেলা তো গতকাল সেই অযোধ্যায় হয়েছে।"
রহিম শেখ জবাবে আরও কিছু একটা বলেছিল, মনে নেই। কীসের আঁচ, কীসের ঝামেলা, কোথায় অযোধ্যা, আমি কিছুই জানতাম না। বুঝতেও পারছিলাম কারা কেন মারল আব্বাকে। শুধু একটা জিনিসই মাথায় পাক খাচ্ছিল তখন, কাল থেকে আর কেউ সকালে বাইকে করে স্কুলের সামনে নামিয়ে দেবে না আমাকে। দিদি তখনও চিৎকার করে কাঁদছে, আম্মি অজ্ঞান। আমি পাথুরে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি আব্বার দুফালি হয়ে যাওয়া গলাটার দিকে। দিদির মতো কাঁদতে চাইছিলাম আমিও, কিন্তু কান্না পাচ্ছিল না।
আমার চারপাশে সব কেমন যেন থেমে গেছিল---স্থির হয়ে গেছিল আব্বার মতোই। গভীর এক নৈঃশব্দ যেন ঝিঁঝির ডাকের মতো বাজছে, ঝিনঝিন করছে মাথাটা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে বসলে যেমন লাগে, আমার ঠিক তেমনই মনে হচ্ছিল। যেন একটা খোয়াব দেখছিলাম এতদিন। আব্বা, আম্মি, দিদি, আমি---একটা সুন্দর স্বপ্ন।
উঠোনে নেমে আব্বার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাইরে তখন কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। খুব শীত করছিল আমার, খুব বেশিই।
"মসজিদটা তো ওরাই ভেঙেছে।" রহিম শেখের কথাগুলো যেন অনেকদূর থেকে ভেসে আসছিল। "এখানেও আব্দুল মিঁয়ার গলায় ছুরি দিয়ে শুরুটা কিন্তু ওরাই করল।"
ওরা মানে কারা ? কোন মসজিদ ? জানতাম না, কিছুই জানতাম না। রান্নাঘরে আব্বার জন্যে ঢাকা দেওয়া লুচিগুলো বোধহয় নেতিয়ে পড়েছে এতক্ষণে। চারপাশে ঘন অন্ধকার। আকাশে টিমটিম করে জ্বলছে তারাগুলো। আর আমাদের উঠোনে একটা লাশ---যাকে আজ সকালেও আব্বা বলে ডেকেছি।
ঘরের ভেতর থেকে চুঁইয়ে পড়া হলদে আলো ছড়িয়ে পড়ছিল আব্বার ওই সাদা কাফনের ওপর। মাঝে মাঝে কালচে লাল রক্তের ছোপ।
থানায় রিপোর্ট করা হয়েছিল সেদিনই। দারোগা অজিত সিং বলেছিল, "কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। যারা এই কাজ করেছে বেশিদিন লুকিয়ে বেড়াতে পারবে না।"
বেশ ভালো লোকটা। লম্বা চওড়া গড়ন, ঠোঁটের নিচে নিখুঁতভাবে ছাঁটা একটা গোঁফ। সরু চোখদুটোতে কেমন একটা শিকারী চাউনি। ভরসা পেয়েছিলাম আমরা। আব্বা তো আর ফিরবে না, তবু খুনিদের শাস্তি যদি হয়, অন্তত কিছুটা সান্ত্বনা তো পাব। সেই অল্প বয়সেও আমার অজিত সিং-কে দেখে মনে হয়েছিল লোকটা 'ওরা' আর 'আমরা'-র বাইরের একটা মানুষ। অনেকটা হিন্দি সিনেমার হিরোদের মতো।
বেশ জোরকদমেই শুরু হয়েছিল আব্বার খুনের তদন্ত। অজিত সিং মাঝেমাঝেই আসত আমাদের বাড়িতে। আব্বার সম্পর্কে, আব্বার বন্ধু, কারখানার লোকেদের সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করত। দিদিই জবাব দিত। আম্মি তখনও কথা বলার অবস্থায় নেই। হাতে একটা পুলিশি খাতা নিয়ে অজিত সিং-এর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকত এক হাবিলদার, তরতর করে লিখে নিত দিদির বয়ানগুলি। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখতাম। মনে হতো আর ক'টা দিন, তারপরেই শাস্তি হবে সেই শয়তানগুলোর। রহিম শেখ যাদের 'ওরা' বলে !
বেশ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছিল অজিত সিং। দিদিকে প্রায়ই থানায় যেতে হতো তদন্তের ব্যাপারে। আমিও যেতে চাইতাম, দিদি নিত না। বলত, "আম্মিকে দেখবে কে ?" আমি বাড়িতে থেকে আম্মিকে দেখতাম আর দিদি আব্বার খুনের তদন্ত দেখত। একদিন সন্ধে নাগাদ হঠাৎ পুলিশের গাড়ি এসে থামল আমাদের উঠোনের সামনে---যেখানে কয়েক সপ্তাহ আগেই আব্বাকে শুয়ে থাকতে দেখেছিলাম। গাড়ির ভেতর থেকে সেই হাবিলদার ডাক দিল, "রাজিয়া, একবার থানায় যেতে হবে। কিছু লোক ধরা পড়েছে। একটু এসে দেখতে হবে এদের কাউকে তোমরা চেনো কি-না।"
আমার বুকের ভেতর কী একটা যেন মোচড় দিয়ে উঠেছিল সেদিন। ওরা ধরা পড়েছে ! এবার নিশ্চয়ই ফাঁসি হবে ওদের। দিদি মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেল, আম্মিকে আমার জিম্মায় রেখে। "দরজাটা লাগিয়ে রাখিস, আমি এসে আম্মিকে ওষুধটা খাইয়ে দেব।"
দিদির কথামতো লাগিয়েই রেখেছিলাম দরজাটা। কিন্তু ওষুধের সময় পেরিয়ে যাবার পরও দিদি আসেনি। রহিম শেখ এসেছিল রাত এগারোটা নাগাদ। হন্তদন্ত হয়ে। "জলদি চল বেটা। সব্বোনাশ হয়ে গেছে।"
বুঝতে পারিনি কিছুই। আম্মি তখন পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে। আমি দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। ছুটতে লাগলাম রহিম শেখের সঙ্গে। কোথায় যাচ্ছি জানি না, শুধু একটা অজানা 'সব্বোনাশ'-এর ভয়ে বুক কাঁপছে। বেশ অনেকটা গিয়ে রায়দের পুরোনো আমবাগানের সামনে থামলাম আমরা। দশ পনেরোজন লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। ভিড় ঠেলে এগোতেই চোখে পড়ল দিদি---শুয়ে আছে। পাথরের মতো কিংবা আব্বার মতো স্থির, নিশ্চল হয়ে। গলায় দড়ি দেবার কালচে দাগ, গায়ের চুড়িদারটা জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। ভিড় থেকে কে একজন যেন বলল, "ওই আমগাছে ফাঁসি দিয়েছিল রাজিয়া। সইদুর প্রথম দেখতে পায়।"
দিদি নিজের গলায় ফাঁসি দিয়েছিল ! কিন্তু ফাঁসি তো হওয়ার কথা ছিল ওদের, যারা আব্বাকে খুন করেছিল। বুঝতে পারছিলাম না, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। রহিম শেখ আবার সেই ঘড়ঘড়ে সুরে বলতে লাগল, "ওই শুয়োরের বাচ্চা দারোগাই করেছে, আমি জানি। নিজের জাতের বিপক্ষে কেন যাবে ও ? উল্টো সুযোগ পেয়ে আমাদের মেয়েটাকেই...", গলাটা আরও একদাগ চড়ে উঠল ওর, "ওদের আমরা ছাড়ব না। অনেক হয়েছে, এবার জবাব দিতেই হবে।"
অজিত সিং ! কিন্তু কেন ? সে তো 'ওরা' আর 'আমরা'-র বাইরের একজন মানুষ ছিল। হিসেবগুলো মিলছিল না আমার। আমার সামনে তখন আব্বার কবরের ওপর শুয়ে থাকা দিদির লাশ; একপাশে রহিম শেখ আর একপাশে অজিত সিং। সত্যিই কি তবে 'ওরা' আর 'আমার'-র বাইরে কেউ হয় না ?
সে-রাতে থানায় অনেকবার খবর দেওয়া হলেও কেউ আসেনি। আমিই গেছিলাম পরদিন থানায়। সঙ্গে আমাদের প্রতিবেশী মইদুল। সে-ই কথা বলছিল অজিত সিং-এর সঙ্গে, আমি শুধু চুপ করে দেখছিলাম।
"রাজিয়াকে রেপ করে খুন করা হয়েছে স্যার, রিপোর্ট লেখাতে এসেছি।"
অজিত সিং কেমনভাবে যেন তাকাল আমাদের দিকে। ওর চোখের চাউনি হাবভাব সব কেমন যেন অন্যরকম। "আচ্ছা। যান ওই কনস্টেবল বসে আছে, ওর কাছে রিপোর্ট লিখিয়ে দিন।"
মইদুল সব বলল। যেখানে যেখানে দরকার পড়ল আমিও বললাম। পুলিশের গাড়ি করে সন্ধের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দিদিকে, সেটাও বললাম। কনস্টেবল রিপোর্ট লিখল। বলল, "কিছু খবর পেলে জানানো হবে।" আমরা বেরিয়ে এলাম। মইদুল বেশ কিছুটা সামনে আর আমি পেছনে। থানার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভেতর থেকে একটা গলা শুনতে পেয়েছিলাম সেদিন, অজিত সিং-এর গলা---"লিখেছ তো ঠিকঠাক ? এবার ছিঁড়ে ফেলে দাও।" সঙ্গে বিদ্রুপমাখা একটুকরো হাসির আওয়াজ।
সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম, আমার দুপাশেই রহিম শেখ, অজিত সিং বলে কেউ নেই। শুধুই 'ওরা' আর 'আমরা' !
'ওরা' মারবে আর 'আমরা' মরব ? হবে না, কিছুতেই হবে না। ঠিকই বলেছিল রহিম শেখ, আমাদের জবাব দিতেই হবে। দিয়েছিলাম। মাসখানেক পর একদিন অজিত সিং-এর কোয়ার্টারের সামনেই ওর বুকে শাবল গেঁথে খুন করেছিলাম ওকে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটকে পড়েছিল আমার চোখেমুখে। ঘাসের ওপর গলগল করে ছড়িয়ে পড়ছিল ওই শয়তানের কালচে রক্ত।
আমি গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছিলাম সেদিনই। প্রথমে মুম্বই, সেখান থেকে হায়দ্রাবাদ। সেখানেই দেখা হয়েছিল নেয়ামত খানের সঙ্গে। সে 'আমাদের' লোক ! ওদের ঘেন্না করত। রহিম শেখও করত, জবাব দেওয়ার কথাও বলত, কিন্তু কোনওদিন কিছু করতে দেখিনি রহিম শেখকে। নেয়ামত জবাব দিতে জানত, আর জানত জবাব দেবার মোক্ষম তারিকাও ! লোকটা বয়সে আমার চেয়ে অনেকটাই বড়, কিন্তু বন্ধুর মতো আপন করে নিয়েছিল আমাকে। বলেছিলাম, আমার সব ঘটনাই খুলে বলেছিলাম ওকে। শুনে বলেছিল, "ইনশাল্লাহ। তুমহারে অন্দর সাচ্চা জেহাদ হ্যাঁয়।"
জেহাদ। গা শিরশির করে উঠেছিল শব্দটা শুনে। ধর্মযুদ্ধ। ক্রুসেড। জেহাদ। কয়েক বছর পর নেয়ামতই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল আমার পাকিস্তান যাবার। সেখানে ওর অনেক যোগাযোগ। জেহাদি দলে যোগ দিয়েছিলাম আমি। বছর দুয়েক ট্রেনিং চলেছিল আমাদের। বোমা ছোঁড়া থেকে বোমা বানানো, পিস্তল, রাইফেল চালানো সব শিখেছিলাম সেখানে। আর শিখেছিলাম 'ওরা' আমাদের দুশমন ! ওদের শেষ করাই সাচ্চা জেহাদ। যদি এই জেহাদে জয়ী হও তবে তুমি গাজী আর যদি মারা যাও তবে তুমি শহীদ। বেহেস্তের শ্রেষ্ঠ আসন তোমার জন্যেই পাতা। 'ওরা' আর 'আমরা'-র মাঝখানে কেউ নেই, কিছু নেই। শুধুই জেহাদ। হয় ওরা নয় আমরা।
টিক টিক টিক টিক ! আমার ভারী জ্যাকেটের ভেতর কোমরে জড়ানো একটুকরো জেহাদ। টিক টিক করে এগিয়ে আসছে বেহেস্তের সেই শ্রেষ্ঠ আসন ! আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড, তারপরেই...। ছোটবেলায় দিদির লাশের সামনে, আব্বার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে শোনা রহিম শেখের সেই কথাগুলো মনে পড়ে গেল---"ওদের আমরা ছাড়ব না। অনেক হয়েছে, এবার জবাব দিতেই হবে।" অজিত সিং-কে জবাব দিয়েছিলাম, কিন্তু একটা অজিত সিং-এ কী হবে ? অযোধ্যার ভাঙা মসজিদ, আমার আব্বার গলাকাটা লাশ, দিদির বেআব্রু শরীর আর গলায় দড়ির দাগ, আমার আম্মির কান্না---এসবের জবাব কেবলমাত্র একটা অজিত সিং তো হতে পারে না !
"আঙ্কেল আঙ্কেল, এহা দেখন্তু মোরা ছোটা কান্ধেই।" চমকে উঠলাম। একটা বাচ্চা মেয়ে, হাতে নতুন কেনা একটা পুতুল নিয়ে আমায় দেখাচ্ছে। উজ্জ্বল দুটো চোখ, খুশিতে ঠিকরে পড়ছে। কে ও ? 'ওরা' না 'আমরা' ? কোনও উত্তর খুঁজে পেলাম না। জেহাদ, বেহেস্ত, আব্বা, আম্মি, দিদি, অজিত সিং, রহিম শেখ, নেয়ামত খান---সব কেমন যেন আবছা হতে হতে মিলিয়ে গেল ওই বাচ্চা মেয়েটার 'ছোটা কান্ধেই'-তে, ছোট্ট পুতুলে। চোখদুটো কেমন জ্বালা জ্বালা করে উঠল হঠাৎ।
চার, তিন, দুই...
______________________________________________________________________
No comments:
Post a Comment