শ ঙ্খ শু ভ্র দে ব ব র্ম ণ
একটি সংক্ষিপ্ত পাঠপ্রতিক্রিয়া
‘তন্তুকীট’ এর পর শুভ্রশংকর দাশ এর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বাউল মলিকিউলস্’। কবিতা বা কবিতার বইয়ের নামকরণ হিসেবে অভিনব অবশ্যই। প্রাচীনপন্থীরা পছন্দ না করলেও লিরিক্যাল নাম এই সময়ে সেকেলে কিম্বা নেহাৎই কাঁচা কাজ বলে মনে হয়। নিজের কথা মনে পড়ে। আমার কবিতা কিম্বা কবিতার বইয়ের নামও প্রথাবিরোধী; আমি অসভ্য নাবিক এবং ত্রিপুরাসুন্দরী এক্সপ্রেস।এমন নামে কাউকে অখুশি হতে দেখে নি। পাঠক এবং আলোচকেরাও কোনও আপত্তি করেন নি। শুভ্রশংকর এই সময়ের কবি। সময়ের ভাষা বা শব্দ তার কবিতায় উঠে আসবে – এটাই স্বাভাবিক এবং কাম্য।
শুভ্রশংকরের কবিতায় গল্প বলার ঝোঁক নেই। বিষণ্ণতা আছে। উচ্চকিত বিষাদ নেই। তার ভাষার বুনোটও চমৎকার। বিদেশি শব্দের আধিক্য অবশ্য অনেকের বিস্ময়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সময়টাকে বুঝতে হবে। শুভ্রশংকরের প্রজন্ম উঠতে বসতে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত অহরহ কী ভাবে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চালায় – সেই আবহ বুঝতে না পারলে বিস্ময়ে ভ্রু কুঞ্চিত হবেই। এই আবহ কতখানি ইতিবাচক সেই প্রসঙ্গে এখন যাচ্ছি না। শুধু এটুকুই বলতে পারি কেউ পছন্দ করুক আর না করুক --- পরিবর্তনের গতিধারাকে রোখা কারোর পক্ষে সম্ভব নয়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে প্রকৃতির নিয়মে বাতিল হয়ে যেতে হয়। এটাই বাস্তব। আর ভাষার বিশুদ্ধতা বলতে কী বোঝায় সে আমার অবশ্য জানা নেই।
শুধু এটুকু বলতে পারি বিভিন্ন বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণে পরিপুষ্ট হয় মূল ভাষা। একটি সমৃদ্ধ ভাষার স্বতোশ্চল প্রবাহমানতা বজায় থাকে এইভাবেই। শুভ্রশংকরের মতো তরুণ কবিরা ভগীরথের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
ভালো লাগে তার কাব্যভাষা। ভালো লাগে তার স্পষ্ট উচ্চারন, ‘‘রিফিল শব্দের বিরুদ্ধে গিয়ে/ শূন্যস্থানগুলো খালি রাখলেই মঙ্গল/এই সুযোগে, আরেকটা ডটপেন দিয়ে/ তার ক্ষেত্রফল টুকে রাখা যায়।’’ ( একটি কলম দিয়ে)।
এরকমই আর একটি চমৎকার কবিতা বাউল মলিকিউলস, ‘‘তুমি আমি যেখানে বসি , তার ঠিক মাঝখানে/ মোম রাখা হয়। তোমার ভাইয়া শিখার চারদিকে/ এঁকে দেয় লবণের অরবিট/ ......ছাদে ঝূলছে কথাঘাস কুয়াশাটুপুর/ দু’পারের মোম গলিয়ে, একতারা বাজাচ্ছে/ বাউল মলিকিউলস’’।
কলুষিত নগরজীবনের যথার্থ প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে ‘হাওয়াই’ কবিতাটি, ‘‘ টিভিতে দেখি – বাউলেরও মরশুম আছে/ নেশায় পেশায় মিলেছে মিথেন/ ...ইশ্বরের ভুল নাস্তিকের গালি/ ডাস্টবিনে বিভূতিভূষণ ছিঁড়ছে পাঁচালি।’’
প্রজন্মের আশা নিরাশার কথা তির্যক ভঙ্গিমায় ব্যক্ত হয়েছে ‘জাদুই কেটলি’ কবিতায়: ‘‘কেবিনে রোগা বাতির টিমটিম/ সেই কবে থেকে ভুল দিক দেখাচ্ছে অসভ্য কম্পাস/ ...সময়ের ইতিহাস...অ্যারাবিয়ান নাইটস/...এই দৃশ্য এঁকেছি / আমি একা পাইরেট।’’
তৃপ্তিতে দ্বার রুদ্ধ করে সংক্ষিপ্ত চতুষ্কোণ ক্ষেত্রফলে কে বাস করতে চায়! অতৃপ্তিবোধের অঙ্কুশাঘাতে রক্তাত্ত হয় অনুভবী তারুণ্য, তাই সে জীবন-অন্বেষায় বেরোয়। অভিযানে বেরোলে কত ঝঞ্ঝা ঝড় সইতে হয়, অজানা পথে পেরোতে হয় কত চড়াই উৎরোই। তৈরি হয় তারপর নতুন দিশা নতুন পথ। পরিশ্রম সার্থক হয়। পরের প্রজন্ম আবার সেই পথেই এগিয়ে চলার সংকেতে উদীপ্ত হয়। শুভ্রশংকরের কলমে তাই দীপ্ত হয় তারুণ্যের চিরন্তন ভাষ্য, ‘‘সব ডোর ছিঁড়ে কাটিয়েছি ঘোর, এখনো দিল মাঙ্গে মোর।’’ (বিরহের ককরোচ)
কবি হিসেবে শুভ্রশংকর পূর্ণতার পথে এগিয়ে চলেছে – এ বিষয়ে নিঃসন্দিহান আমি। তবে চলার পথে শুভ্রশংকরকে মনে রাখতে হবে দু চারটি কথা। কবিতার বৈশ্বিক ভাষাই একমাত্র শেষ কথা নয়; স্থানীয় বা আঞ্চলিক মাটি এবং সংস্কৃতির স্পর্শ না থাকলে নিজস্বতা গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। কথাটা গুরুত্বপূর্ণ এবং এ বিষয়ে ভাবতে হবে সিরিয়াসলি। নতুবা কবিতা হিসেবে সৃজনশীলতা সার্থক হয়ে উঠলেও কবি হিসেবে অন্যান্য কবিদের ভিড়ে মিশে যাওয়ার শঙ্কা থেকে যায় ষোল আনা! নিজস্ব ফুটপ্রিন্ট বা পদচিহ্ন তৈরি করতে হবে। দীক্ষিত পাঠক যেন কবিতার প্রথম লাইন পড়েই বলতে পারে, হ্যাঁ এইতো শুভ্রশংকরের কবিতা। স্বতন্ত্র সত্তা গড়ে তোলা দরকার তাই প্রত্যেক কবির। তার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন ব্যাপক অধ্যয়ন, পর্যবেক্ষণ আর চর্চা।
স্রোত প্রকাশিত বইটির ছাপা ও প্রচ্ছদ ভালো। দাম ৭০ টাকা।
__________________________________________________________________________________
__________________________________________________________________________________
1 comment:
খুব সুন্দর একটি আলোচনা।
পড়েছি বাউল মলিকিউলস, ভীষণ সুন্দর সৃষ্টি...
Post a Comment