হু মা য়ূ ন ক বী র ঢা লী
আগাছা ও নিড়ানি বিষয়ক একটি স্মৃতিগল্প
বোকাকাহিনি
চৈত্র মাসের সতর তারিখে বেলতলির বদরপুরে লেংটারমেলা বসে। এই মেলা বসে শাহ সোলেমান আউলিয়ার নামে। তিনি উপমহাদেশের একজন খ্যাতিমান আউলিয়া হিসেবে পরিচিত ছিলেন। শাহসূফি সোলেমান লেংটা কুমিল্লা জেলার বর্তমান মেঘনা উপজেলার আলীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন মতলবের বিভিন্ন অঞ্চলে। মারা যান বদরপুরে। বদরপুর এখন চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলায় অবস্থিত। একসময় চাঁদপুর ছিল কুমিল্লা জেলার একটি মহকুমা। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখনো এটি মহকুমা। ঊনিশ’শ সাতাত্তর কি আটাত্তরের কথা। তখন মতলব থানা উত্তর দক্ষিণে ভাগ হয়নি। বাইশটি ইউনিয়ন নিয়ে মতলব থানা গঠিত ছিল। এতবড় থানা বাংলাদেশের আর কোথাও ছিল বলে মনে হয় না। এক থানায় সংসদীয় আসন ছিল দুটি।
কথিত আছে, শাহ সোলেমান শরীরে কখনো পোশাক রাখতেন না। তাই তার মৃত্যুর পর তার কবরটি লেংটার মাজার হিসেবে পরিচিতি পায়। প্রতিবছর সতর চৈত্র তার জন্মদিন উপলক্ষে সাতদিন ব্যাপী ওরস অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তার ভক্ত-আশেকানরা এসময় বদরপুরে এসে ভীড় করে। আউলিয়ার গুণকীর্তন করে। জিগির-আজগার, কান্নাকাটি করে।
আমি তখন ছেংগারচর উচ্চ বিদ্যালয়ে পরি। সেভেন কি এইটে।
কদিন পরেই লেংটার মেলা। টাকা-পয়সা জমানোর চিন্তা। বাবা-মা’র কাছ থেকে যা পাই, খরচ করি না। ঘরের বাঁশের পালা (পিলার হিসেবে ব্যবহৃত) ফুটো করে তাতে টাকা-পয়সা জমাই। জানি, এতে হবে না। আরও টাকা জমাতে হবে। কী করি? পুরনো খাতার দিকে নজর দেই। বেশি বেশি করে লিখে নতুন খাতা পুরনো করি। সের হিসেবে বিক্রি করে যদি কিছু টাকা আসে। বিক্রি করলাম। বিক্রি করে যা পেলাম তা পকেটের তলানিতে পড়ে থাকবে। বিকল্প ব্যবস্থা খোঁজা শুরু করলাম। সমমনা বন্ধুদের নিয়ে এলাকার ডোবা-নালা সেচে মাছ ধরি। নিজেদের বাবা-মা’র কাছে বিক্রী করি। এভাবে জমাতে থাকি টাকা। কারণ, লেংটার মেলায় যাবো। যাওয়ার আগে মনে মনে ফর্দ তৈরি করি কি কি কিনব। বাঁশি, খেলনা, লাঠিম, পুতুলসহ নিজের ও ছোট ভাইবোনের জন্য নানাকিছুর তালিকা মনে ঢুকিয়ে রাখি। সেই সাথে দেখতে হবে সার্কাস, পুতুল নাচসহ নানারকম অনুষ্ঠানাদি। তাই এসবের জন্য আরও আরও টাকা রোজগার করা দরকার।
কেউ জমি নিড়ানি দিতে আমাদের কামলা নেবে কিনা, সে চেষ্টা-তব্দির করতে থাকি। সুযোগ একটা এসে যায়। চার বন্ধু মিলে রউফ চাচার আউশ ধানের জমি কণ্ট্রাক নিলাম। কুড়পাড়ের আধাকানি জমি। ধারণা করলাম দুতিন দিনে শেষ করে দিতে পারব। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে নিড়ানি দিয়ে দেব। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে বইপত্র রেখে একটু খেয়েই ছুটে গেলাম মাঠে। কিন্তু সমস্যা হলো, বন্ধুদের সবার খন্তাকাচি থাকলেও আমারটা এখনো জোগার করতে পারিনি। কী করা! বড় জ্যাঠার ঘর থেকে নানাছল দেখিয়ে খন্তাকাচি নিয়ে নিলাম। যথারীতি ক্ষেত নিড়ানি দিতে চলে গেলাম। বন্ধুদের সবাই কৃষি কাজের সাথে জড়িত। তাই যে কোনো ধানের আগাগোড়া চেনে ওরা। আমি চিনি না। তাই বদু বলল, কিরে নিড়ানি দিতে পারবি তো?
পারুম না কেন, জমি নিড়ানি দেওয়া কোনো ব্যাপার হলো।
দেখিস কিন্তু।
আচ্ছা।
চার বন্ধু, বদু, নাসির, মনির ও আমি জমি নিড়ানি দিচ্ছি। ওরা আমার আগে আগে সাড়ি শেষ করে নতুন সাড়িতে বসলেও আমি একটা নিয়েই সময় পার করে দিচ্ছি। তবুও বন্ধুরা কিছু বলে না। ওরা জানে আমার অবস্থা। ওরা দু সাড়ি শেষ করতে করতে আমি মাত্র এক সাড়ি শেষ করলাম। বন্ধু নাসির কী মনে করে আমি কেমন নিড়ানি দিয়েছি তা পরীক্ষা করতে এলো। এসেই ওর মাথায় হাত।
কিরে হুমায়ূন তুই এইডা করছস কী!
ক্যান কি করছি?
আউশ ধানের গোড়া তো লাল। যেসব ধান গাছের গোড়া লাল তা রেখে বাকিগুলো তুলে ফেলবি। তুই যে দেখছি সাদা গোড়া রেখে লালগুলো তুলে ফেলছিস।
নাসিরের কথা অন্য বন্ধুরাও ছুটে এলো। সকলের মুখে হায় হায়, এ কী করেছিস?
আমি বোকা হয়ে গেলাম। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম কতক্ষণ। এরপর বললাম, যা করার তো করেই ফেলেছি, এখন কী করব বল?
কী
যে বলব! একটা কাজ কর লাল গোড়া দেখে দেখে ধানগাছগুলো ফের লাগিয়ে দে। নাসিরের কথায় সবাই সায় দিলো।
কী
আর করা! হাদারামের মতো ফের বসে পড়লাম যেসব ধানগাছ তুলে ফেলেছিলাম, সেগুলো রোপন করার জন্য।
____________________________________________________________________
No comments:
Post a Comment